রপ্তানি আয় রেমিট্যান্সের পর বিদেশি ঋণেও বড় ধাক্কা

বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে সরকার। দাতাদের কাছ থেকে একটার পর একটা ঋণের প্রতিশ্রুতি মিলছে; পাওয়াও যাচ্ছে কিছু কিছু। বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঋণের প্রতিশ্রুতি মিলেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওয়াশিংটন সফরে ২২৫ কোটি (২.২৫ বিলিয়ন) ঋণের চুক্তিও সই হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া ৩০০ কোটি (৩ বিলিয়ন) ডলার দেবে বলে চুক্তি সই করেছে। এডিবি, জাইকা, এআইআইবির কাছ থেকেও ঋণের আভাস মিলেছে। আইএমএফের ৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ডলার ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার ইতিমধ্যে পাওয়া গেছে।

কিন্তু রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পর বিদেশি ঋণেও বড় ধাক্কা লেগেছে। সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সর্বশেষ তথ্য বলছে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) দাতাদের বিদেশি ঋণ ছাড় ও প্রতিশ্রুতি হতাশাজনক। এই ৯ মাসে উন্নয়ন সহযোগীরা ৫৩৬ কোটি ৩০ লাখ (৫.৩৬ বিলিয়ন) ডলার ছাড় করেছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২১ শতাংশ কম। ২০২১-২২ অর্থবছরের এই ৯ মাসে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে ৬৭৯ কোটি ৭০ লাখ (৬.৭৯ বিলিয়ন) ডলার অর্থায়ন করেছিল দাতারা। এ সময়ে প্রতিশ্রুতি প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। গত অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে ৫ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ-সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থা। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে ৩ দশমিক শূন্য ৭ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। শতাংশ হিসাবে কমেছে ৪৩ শতাংশ।

বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে যেকোনো দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক হচ্ছে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ। কিন্তু এই রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমতে কমতে ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মার্চ-এপ্রিল মেয়াদের ১ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর গতকাল সোমবার রিজার্ভ ২৯ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সের পর রিজার্ভের অন্যতম উৎস হচ্ছে বিদেশি ঋণসহায়তা। এপ্রিলে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বেশ কমেছে; রেমিট্যান্স কমেছে ১৬ দশমিক ৭৬ শতাংশ। আর রপ্তানি আয় কমেছে ১৬ দশমিক ৫২ শতাংশ।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলা মহামারি করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে গত অর্থবছরে বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে প্রত্যাশার চেয়েও বেশি ঋণসহায়তা পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু এখন তো আর কোভিডের ঋণ পাওয়া যাচ্ছে না। অস্থির বিশ্ব পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশকে ঋণ দিতে হচ্ছে দাতা সংস্থাগুলোকে। সে কারণেই বিদেশি ঋণ কমছে। আমার মনে হচ্ছে, এবার গতবারের চেয়ে ঋণ বেশ খানিকটা কম আসবে। তবে আশার কথা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র সফরে মোটা অঙ্কের ঋণের প্রতিশ্রুতি মিলেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গেও বড় অঙ্কের ঋণের চুক্তি সই হয়েছে। এডিবি ও জাইকার কাছ থেকেও বাজেট সহায়তা পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে এসব ঋণ আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পাওয়া যাবে। তখন হয়তো বিদেশি ঋণ বাড়বে। তার আগপর্যন্ত অর্থাৎ জুন পর্যন্ত বিদেশি ঋণ নিয়ে তেমন সুখের খবর নেই।’

তবে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের সম্পর্কের যে টনাপোড়েন দেখা দিয়েছিল সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট ডেভিড মালপ্যাচের আমন্ত্রণে বাংলাদেশ-বিশ্বব্যাংকের সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে বিশ্বব্যাংক সদর দপ্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অংশগ্রহের মধ্য দিয়ে তার একটি সুন্দর পরিসমাপ্তি হলো বলে মনে করেন আহসান মনসুর। আর এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বড় বড় প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের পথ মসৃণ হলো বলেও মনে করেন দীর্ঘদিন বিশ্বব্যাংক গ্রুপের সহযোগী সংস্থা আইএমএফের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা এই অর্থনীতিবিদ।

সবচেয়ে বেশি দিয়েছে জাপান

ইআরডির তথ্যে দেখা যায়, বরাবরের মতো এবারও সবচেয়ে বেশি ঋণসহায়তা পাওয়া গেছে জাইকার কাছ থেকে। জুলাই-মার্চ সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন-সহযোগী জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে। অন্য উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যে বিশ্বব্যাংক ৮৫ কোটি ৪৩ লাখ ডলার, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ৮০ কোটি ১৯ লাখ ডলার, রাশিয়া ৭৪ কোটি ৭২ লাখ ডলার, চীন ৬৩ কোটি ৭৭ লাখ ডলার ছাড় করেছে।

জুলাই-মার্চ সময়ে সবচেয়ে বেশি প্রতিশ্রুতিও পাওয়া গেছে জাইকার কাছ থেকে। সংস্থাটির কাছ থেকে এই ৯ মাসে প্রতিশ্রুতি এসেছে ১ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া এডিবির কাছ থেকে ৮৪ কোটি ৪৭ লাখ ডলার, বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ৩০ কোটি ডলার এবং এআইআইবির কাছ থেকে ২৫ কোটি ৩৫ লাখ ডলার প্রতিশ্রুতি মিলেছে।

সুদ পরিশোধ বেড়েছে ২৯ শতাংশ

জুলাই-মার্চ সময়ে আগে নেয়া ঋণের আসল ও সুদ বাবদ ২০৫ কোটি ৯০ লাখ (২.০৫ বিলিয়ন) ডলার পরিশোধ করেছে সরকার। গত বছরের একই সময়ে পরিশোধ করা হয়েছিল ১ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার। এ হিসাবে এই ৯ মাসে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে সুদ-আসল পরিশোধ বাবদ ২৯ শতাংশ বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে সরকারকে।

রাশিয়ার কাছ থেকে রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পের ঋণের আসল ও সুদ বাবদ প্রায় ৩৩ কোটি ডলার পরিশোধের কারণে মার্চে সরকারের মোট ঋণ পরিশোধ বেড়েছে বলে জানান ইআরডি কর্মকর্তারা।

অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ১০ বিলিয়ন (১ হাজার কোটি) ডলারের বেশি বিদেশি ঋণ পেয়েছিল বাংলাদেশ, যা ছিল আগের বছরের চেয়ে ২৬ শতাংশ বেশি। দুই বছরের করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় চাপে পড়া অর্থনীতিকে সামাল দিতে কম সুদের বিশাল অঙ্কের এই ঋণ বেশ অবদান রেখেছিল।

২০২০-২১ অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ৭৯৫ কোটি ৭৫ লাখ ৬০ হাজার (৭ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন) ডলার ঋণসহায়তা পেয়েছিল বাংলাদেশ। তার আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসেছিল ৭৩৮ কোটি (৭ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন) ডলার।

বাংলাদেশে বিদেশি ঋণ বাড়তে থাকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে। ওই বছরই এক লাফে অর্থছাড় ৩০০ কোটি থেকে ৬৩৭ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। তারপর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আসে ৬৫৪ কোটি ডলার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *