৪৮১৯ কোটি টাকা শোধের শর্তে ৩৩৫৯ কোটি মাফ

আগামী জুনের মধ্যে ৫ হাজার কোটি টাকা পরিশোধের শর্তে ঋণ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়া বহুল আলোচিত এননট্যাক্স গ্রুপকে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা সুদ মওকুফ করে দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক।

ঋণ কেলেঙ্কারিতে ডুবতে বসা এই প্রতিষ্ঠানটির মালিকানা বদলের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তা রহস্যজনক কারণে থমকে গেছে। গত কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন মহলে আলোচনা ছিল দায়দেনাসহ প্রতিষ্ঠানটি দেশের অন্যতম প্রধান শিল্প গ্রুপ এস আলম কিনে নেবে। কিন্তু দৈনিক বাংলার পক্ষ থেকে গতকাল বুধবার এননট্যাক্স এবং এস আলম গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, আপাতত হাতবদল প্রক্রিয়া থমকে গেছে।

এই বিপুল অঙ্কের সুদ মওকুফ বিষয়ে জানতে চাইলে জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান এস এম মাহফুজুর রহমান গতকাল বুধবার দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘নিয়মনীতি অনুসরণ করে গত বছরের নভেম্বরে ব্যাংকের ৭৪৬তম বোর্ড সভায় এননট্যাক্সের সুদ মওকুফ করা হয়েছে। বাকি অর্থ পরিশোধ করতে জুন পর্যন্ত সময় দেয়া হয়েছে। জুনের মধ্যে অর্থ পরিশোধ করতে পারলে তাকে দায় থেকে অব্যাহতি দেয়া হবে।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তের আলোকে এই সুদ মওকুফ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

তবে বিপুল অঙ্কের সুদ মাফ করে দেয়ার ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। দৈনিক বাংলাকে তিনি বলেন, ‘সুদ মওকুফ করে দেয়ার সুযোগ সবাই চায়। এত বিপুল পরিমাণ অর্থের দুর্নীতি হওয়ার পেছনে দুই পক্ষই (জনতা ব্যাংক ও এননট্যাক্স গ্রুপ) দায়ী। ঋণ না দেয়ার জন্যই ঋণ নেয়া হয়েছিল। এতে ব্যাংকের কর্মকর্তারাও জড়িত ছিলেন। এই ঋণ কেলেঙ্কারি ব্যাংক খাতে সংকট তৈরি করেছে। যার প্রভাব অর্থনীতিতেও পড়েছে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘ঋণ পুনঃতফসিল ও সুদ মওকুফের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন রয়েছে। সে নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংক তার নিজস্ব বিবেচনায় সুদ মওকুফ করে থাকে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের এনওসি (অনাপত্তি সনদ) দরকার হয় না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনের ব্যত্যয় ঘটলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান এস এম মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘এননট্যাক্স গ্রুপের ১৮টি প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রকল্প ঋণ, সিসি (হাইপো: টার্ম লোন) ও সৃষ্ট পিএডিসহ (টার্ম লোন) জনতা ব্যাংকের বর্তমানে ৮ হাজার ১৭৮ কোটি ৯২ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে। এর মধ্যে ৩ হাজার ৩৫৯ কোটি ১৯ লাখ টাকার সুদ মওকুফ করে দেয়া হয়েছে। আগামী জুনের মধ্যে এননট্যাক্স গ্রুপ জনতা ব্যাংকের ৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা পরিশোধ করবে- এই শর্তে সুদ মাফ করে দেয়া হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে এননট্যাক্স নির্ধারিত টাকা পরিশোধ করতে না পারলে ঋণটি আগের অবস্থায় ফিরে যাবে এবং পুনরায় তা মন্দমানের ঋণে শ্রেণীকরণ করা হবে।

জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ‘ওয়ান টাইম এক্সিট’ নীতির আলোকে এননট্যাক্স গ্রুপকে বিশাল অঙ্কের এ সুদ মওকুফ করা হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক সুদ মওকুফ ও ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধা ব্যাংকগুলোর হাতে ছেড়ে দেয়। এরপর নিজেদের ক্ষমতা বলে বিশাল অঙ্কের সুদ মওকুফ করে জনতা ব্যাংক। তবে এ পরিমাণ সুদ মওকুফের পরও এননট্যাক্স বাকি ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম হবে কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন আহসান এইচ মনসুর।

তিনি বলেন, ‘এখন প্রশ্ন হচ্ছে, জুনের মধ্যে এননট্যাক্স ৫ হাজার কোটি টাকা শোধ করতে পারবে কী? যদি না পারে, তাহলে কী হবে? ঋণটা মন্দ হবে। কিন্তু টাকাটা তো আদায় হবে না।’

জনতা ব্যাংক ২০১০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে এননট্যাক্স গ্রুপের ১৮টি প্রতিষ্ঠানকে ৩ হাজার ৪১৭ কোটি ৯ লাখ টাকা ঋণ দেয়, যা জনতা ব্যাংকের মূলধনের ২৫ শতাংশেরও বেশি। ব্যাংক কোম্পানি আইনে একক ঋণগ্রহীতার এক্সপোজার সীমা লঙ্ঘন করে এই ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল। ব্যাংক কোম্পানি আইনে কোনো ব্যাংক তার মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি একটি গ্রুপকে দিতে পারে না।

২০০৮ থেকে ২০১৪ সাল- ছয় বছরে রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংকের ভিত কাঁপিয়ে দেয় যে প্রতিষ্ঠান, তার নাম এননটেক্স। নিয়মনীতি না মেনে এই গ্রুপকে দেয়া হয় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার ঋণ। যার সিংহভাগই এখনো খেলাপি।

মালিকানা বদল হচ্ছে না

বেশ কিছুদিন ধরে শোনা যাচ্ছিল এই প্রতিষ্ঠানের মালিকানা বদল হচ্ছে, কিনে নিচ্ছে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প গ্রুপ এস আলম গ্রুপ। তবে এ ব্যাপারে মুখ খুলছে না কোনো পক্ষই। এননট্যাক্সের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সময়ই বলে দেবে সব। জনতা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বলছে, তিন মাসের মধ্যে আসবে নতুন খবর। এ ক্ষেত্রে খেলাপি হওয়া টাকা ফেরত দেয়া ছাড়াও আসবে অন্য ঘোষণা।

বাজারে এননটেক্সের মালিকানা পরিবর্তনের গুঞ্জন রয়েছে। বড় একটি শিল্পগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠানটি কিনে নিচ্ছে এটা সত্যি কি না জানতে চাইলে এননট্যাক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইউনুছ বাদল দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘গুঞ্জন কখনো সত্যি হয় নাকি? আমি তো টাকা দিয়ে ঋণ রিসিডিউল (পুনঃতফসিল) করেছি। যদি এটা সত্য হতো তাহলে অন্য গ্রুপ এটা টাকা দিয়ে করত। এখন দ্বিতীয় দফায় ঋণ নিয়মিত করা হচ্ছে।’

এস আলম গ্রুপের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘এননট্যাক্স গ্রুপের শেয়ার কেনার বিষয়টি নিয়ে এক ধরনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু আপতত সেই পরিকল্পনা নিয়ে আর ভাবছে না এস আলম গ্রুপ।’

যেভাবে ঋণ কেলেঙ্কারি

২০১০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে এননট্যাক্স গ্রুপের ২২টি সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে জনতা ব্যাংক ৫ হাজার ৫০৪ কোটি টাকার ঋণ ও ঋণসুবিধা দেয়, যা সুদাসলে ৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। নিয়মনীতি না মেনে এভাবে ঋণ দেয়ায় বিপদে পড়ে জনতা ব্যাংকও। কারণ গ্রাহকও ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি।

২০০৪ সাল থেকে জনতা ব্যাংকের শান্তিনগর শাখায় প্রথম ব্যাংকিং সুবিধা গ্রহণ করে এননট্যাক্স গ্রুপের জুভেনিল সোয়েটার। ওই শাখার বেশি ঋণ দেয়ার ক্ষমতা না থাকায় ২০০৮ সালে জনতা ভবন করপোরেট শাখায় ঋণটি স্থানান্তর করা হয়। ২০১০ সাল থেকে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান খুলে ঋণসুবিধা নেয়া শুরু হয়।

জনতা ব্যাংকের মোট মূলধন ২ হাজার ৯৭৯ কোটি টাকা। মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দেয়ার সুযোগ আছে। অর্থাৎ এক গ্রাহক ৭৫০ কোটি টাকার বেশি ঋণ পেতে পারেন না। দেয়া হয়েছে মোট মূলধনের প্রায় দ্বিগুণ।

২০১৮ সালে একটি তদন্ত প্রতিবেদনে এননট্যাক্স গ্রুপের পরিচালিত ২২টি সহযোগী প্রতিষ্ঠানের বড় ঋণ অনিয়ম এবং অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। রাষ্ট্রীয় জনতা ব্যাংক থেকে এননট্যাক্স গ্রুপের প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা ঋণের সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার ইউনুছ বাদল একাই।

ব্যাংকটির মতিঝিল প্রধান কার্যালয় জনতা ভবন শাখার এননট্যাক্সের বিপুল ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা আলোচিত আর্থিক কেলেঙ্কারিগুলোর অন্যতম। কারণ একটি শাখা থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ বিতরণের ঘটনা এর আগে ঘটেনি। তাই এটিকে একক ব্যক্তির ঋণে বৃহত্তম কেলেঙ্কারি হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।

এ বিশাল অঙ্কের খেলাপি ঋণ আদায় করতেই এননট্যাক্স গ্রুপের কিছু ঋণ পুনঃতফশিলের সুযোগ দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক।

কেশবপুরে জাতীয় বীমা দিবস উদযাপন

ডায়াবেটিস রোগীদের রোজা পালন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *