বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও সম্পর্ক যেকোনো সময়ের চেয়ে জোরদার ঢাকার। কোনোভাবেই এই দুই পরাশক্তির মধ্যকার দ্বন্দ্বের অংশীদার নয় বাংলাদেশ। তার পরও দুই পরাশক্তির স্নায়ুযুদ্ধের প্রভাব পড়ছে এ দেশে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় থাকা রাশিয়ার একটি জাহাজকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না দেয়া নিয়ে এক ধরনের কূটনৈতিক জটিলতা তৈরি হয়েছে।
এই ইস্যুতে সম্প্রতি রাশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কামরুল আহসানকে তলব করে ঢাকাকে অবাক করেছে রাশিয়া। ঘটনার কয়েক দিন পেরিয়ে গেলেও এখনো আনুষ্ঠানিক জবাব দেয়নি ঢাকা। দিনভর গণমাধ্যমকর্মীদের অপেক্ষার পর গত বুধবার সন্ধ্যায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘রাশিয়ায় আমাদের রাষ্ট্রদূতের কাছে বিস্তারিত প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে। প্রতিবেদন পেলে আমরা সেটি বিশ্লেষণ করব। এ বিষয়ে আমাদের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া বৃহস্পতিবার জানাব।’
বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে রাশিয়ান জাহাজ ছাড়াও দ্বিপক্ষীয় আরও কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানান পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, ভূরাজনৈতিক কারণে রাশিয়া বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিধর দেশগুলোর কাছে বাংলাদেশ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশও ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। কিন্তু সম্প্রতি এ দুই দেশের বৈরিতার প্রভাব বাংলাদেশে পড়ছে।
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব শমসের মবিন চৌধুরী দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘রাশিয়ার জাহাজ উরসা মেজর ইস্যুতে বাংলাদেশ যথার্থ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই জাহাজ ভারতও গ্রহণ করতে পারেনি। কিন্তু এই জাহাজকে কেন্দ্র করে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার দ্বন্দ্বের অংশীদার বাংলাদেশ না হলেও তার একটা প্রভাব এ দেশে পড়ল।’
শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, মস্কো-ঢাকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে এর প্রভাব কতটুকু পড়বে তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। রাশিয়ার বেশ কয়েকটি প্রকল্প বাংলাদেশে আছে, একসময় সামরিক সহযোগিতা ছিল- এসব ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব পড়বে কি না সেটা সময়ে দেখা যাবে।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় উরসা মেজরকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পণ্য খালাস করতে নিষেধ করে বাংলাদেশ। গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর জাহাজটির মোংলা বন্দরে ভেড়ার কথা ছিল। তবে তার আগেই ২০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে জানায় যে ওই জাহাজটি আসলে ‘উরসা মেজর’ নয়। এটি মার্কিন নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা ‘স্পার্টা ৩’ জাহাজ। রং ও নাম বদল করে তাদের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা জাহাজটি রূপপুরের পণ্য নিয়ে বাংলাদেশে আসছে, যা প্রকৃতপক্ষে ‘স্পার্টা’র সনদ নম্বর। যাচাই করে বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে জাহাজটি বন্দরে ভিড়তে নিষেধ করে দেয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকতে না পারলেও বঙ্গোপসাগরের আশপাশেই ছিল উরসা মেজর।
আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স গত মঙ্গলবার কামরুল আহসানকে তলব করার কথা বললেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা দৈনিক বাংলাকে বলেন, আসলে রাষ্ট্রদূত কামরুল আহসানকে তলব করা হয়েছিল ২০ ফেব্রুয়ারি সোমবার। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রেরে মালামাল নিয়ে আসা রুশ জাহাজ উরসা মেজরকে বাংলাদেশে ঢুকতে না দেয়ার পাশাপাশি ৬৯টি রুশ জাহাজকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে তাকে তলব করা হয়।
সূত্র জানায়, রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী আন্দ্রে রোদেনকো মস্কোতে তার দপ্তরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কামরুল আহসানকে তলব করেন। প্রায় আধা ঘণ্টার বৈঠকে তিনি জাহাজ ইস্যুতে রাশিয়ার সরকারের অসন্তোষের কথা তুলে ধরেন। আন্দ্রে রোদেনকো বলেন, উরসা মেজরকে বাংলাদেশে পণ্য খালাস করতে না দেয়ার খবর প্রকাশের পর রাশিয়া সরকার জনগণের প্রশ্নের মুখে পড়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের সম্পর্ক প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
রাশিয়ার এই জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশকে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনের কথা স্মরণ করে দেন। উরসা মেজরকে প্রবেশের অনুমতি না দেয়ায় বাংলাদেশের জন্মলগ্নেই শুরু হওয়া ঐতিহাসিক বন্ধুত্বপূর্ণ থেকে সরে আসা বলে মনে করছে রাশিয়া।
আন্দ্রে রোদেনকো রাশিয়াকে বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু উল্লেখ করে বাংলাদেশের এ আচরণ যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবে হয়েছে বলে মন্তব্য করেন। বাংলাদেশ পশ্চিমা চাপের কাছে মাথা নত করছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। উরসা মেজরকে ঘিরে বাংলাদেশের পদক্ষেপ দুই দেশের সহযোগিতামূলক সম্পর্কে বিরূপ প্রভাব আনতে পারে- এমন শঙ্কার কথা তুলে ধরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে তা ঢাকায় জানানোর কথা বলেন আন্দ্রে রোদেনকো।
এ সময় রাষ্ট্রদূত কামরুল আহসান বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরে বলেন, ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই বাংলাদেশকে নিজেদের পক্ষে নিতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের চাপ দিয়ে যাচ্ছে। তার পরও বাংলাদেশ তার স্বকীয়তা বজায় রেখেছে। নিরপেক্ষ অবস্থানে রয়েছে।
উরসা মেজর জাহাজটি বঙ্গোপসাগরে ভেসে বেড়াচ্ছে এখনো। গ্লোবাল শিপ ট্র্যাকিং ইন্টেলিজেন্স মেরিন ট্রাফিক ওয়েবসাইট থেকে সর্বশেষ হালনাগাদ এ তথ্য জানা গেছে।
ভারতের সাগর-বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে বর্তমানে রুশ জাহাজটি বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ অংশে নোঙর অবস্থায় রয়েছে। জাহাজটি ঠিক কোথায় যাবে, তা এখনো সুনির্দিষ্ট করেনি।