রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চাকরিতে ঢুকেছিলেন মাস্টাররোলে, পদ কার্য-সহকারী। বর্তমানে পদোন্নতি পেয়ে হয়েছেন রেখাকার, তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর পদ এটি। বেতন পান সর্বসাকল্যে ৩৫ হাজার টাকার মতো। কিন্তু অদৃশ্য আয়ে তিনি এখন কোটি কোটি টাকার মালিক।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকার মধ্য পীরেরবাগে তার রয়েছে ১০ তলা ও ৭ তলাবিশিষ্ট দুটি বাড়ি। স্ত্রীর মালিকানায় করেছেন আবাসন কোম্পানি। সেই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে একাধিক বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। চলাফেরা করেন নিজের গাড়িতে। নামে-বেনামেও রয়েছে প্লট ও ফ্ল্যাট। গ্রামের বাড়িতেও করেছেন বিপুল সম্পদ। আলোচিত এই রাজউক কর্মচারীর নাম মোহাম্মদ শফিউল্লাহ বাবু।
বাবুর গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের কাজীপুর থানাধীন শুভগাছায়। ১৯৯৬ সালে প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিমের মাধ্যমে আরও অনেকের সঙ্গে রাজউকে মাস্টাররোলে চাকরিতে ঢোকেন বাবু। সে সময় ‘কাজ নেই পয়সা নেই’ (কানামনা) ভিত্তিতে কার্য-সহকারী হিসেবে চাকরি শুরু। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় তার চাকরি চলে যায়। পরবর্তী সময়ে আইনের আশ্রয় নিয়ে আরও অনেকের মতো তিনিও চাকরি ফিরে পান। চাকরি স্থায়ী হওয়ার পর পরই যেন ‘আলাদিনের চেরাগ’ হাতে পান তিনি। গত এক যুগে রীতিমতো ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ হওয়ার মতো সম্পদ গড়ে তুলেছেন তিনি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শফিউল্লাহ বাবু দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘আমার যদি অবৈধ সম্পদ থাকে তাহলে সরকার তা ক্রোক করুক। এতে আমি কোনো বাধা দেব না।’ সাধারণ একজন কর্মচারী হয়ে এত সম্পদের মালিক কীভাবে হলেন জানতে চাইলে তিনি রাগান্বিত হয়ে বলেন, ‘আপনার কাছ থেকে নিয়েছি, মানুষের কাছ থেকে নিয়েছি।’ পরে তিনি বলেন, ‘কাগজে-কলমে আমার নামে কিছু নাই।’ আপনার স্ত্রী কুলসুমী আক্তার লিজা এত সম্পদের মালিক কীভাবে হলেন জানতে চাইলে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি। একপর্যায়ে মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজউকে যোগদানের পর মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানেই কোটি কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ গড়ে তোলেন তিনি। রাজউকের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর নকল করে নকশা জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। খুব সহজেই যেকোনো ব্যক্তির স্বাক্ষর হুবহু নকল করতে পারেন তিনি। এ ছাড়া রাজউকের অধিকাংশ কর্মকর্তার নাম ও পদবি-সংবলিত সিল থাকে তার কাছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র সত্যায়িত করার পাশাপাশি জাল-জালিয়াতিতে সিদ্ধহস্ত তিনি।
সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর মধ্য পীরেরবাগের ৯৩ নম্বর প্লটের বহুতল একটি ভবনে একটি ফ্ল্যাট ছিল তার। পরিবার নিয়ে সেখানেই থাকতেন। সেই বাসার পাশেই ৯৫/এ নম্বর প্লটে একটি ১০ তলা ভবন বানিয়েছেন। এই ভবনে ৩০টি ফ্ল্যাট রয়েছে তার। ছয়তলার একটি ফ্ল্যাট তিনি নিজের জন্য ব্যবহার করেন। তবে পরিবার নিয়ে থাকেন মধ্য পরীরেরবাগের ষাট ফিট সড়কের পাকা মসজিদের পাশেই একটি সাততলা ভবনে। এটিও তার নিজের বাড়ি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাজউকের চাকরিতে থাকা অবস্থায় তিনি একটি ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান খোলেন। প্রথমে এটির নাম ছিল নিপ্পন প্রোপার্টিজ। পরে নাম পরিবর্তন করে নিজের সন্তানের নামে অপ্সরা হোমস লিমিটেড নামে জয়েন্ট স্টক থেকে নিবন্ধন নেন। ২০১১ সাল থেকে চালু করা এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তার স্ত্রী কুলসুমী আক্তার লিজা। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে তার শ্বশুর হুমায়ুন কবীর (সদ্যপ্রয়াত), ভায়রা আজহার ও ভাই দিপুও জড়িত।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অপ্সরা হোমস লিমিটেডের অধীনে বর্তমানে একাধিক বহুতল ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। মধ্য পরীরেরবাগের ৩৭৯/১ নম্বর প্লটে তিনি ছয়তলা একটি ভবন নির্মাণ করেন। ভূমির মালিক তমিজ উদ্দিনের সঙ্গে অর্ধেক ফ্ল্যাট ভাগাভাগিতে করা ওই ভবনটির নাম অপ্সরা সায়েম গার্ডেন। ওই বাসার নিরাপত্তারক্ষী ইজ্জত আলী জানান, ওই ভবনে বাবুর মালিকানাধীন ফ্ল্যাটগুলো বিক্রি করে দিয়েছেন বলে তিনি শুনেছেন। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক ব্যক্তি জানান, ওই ভবনে বাবুর এখনো একাধিক ফ্ল্যাট রয়েছে।
সরেজমিন অনুসন্ধানে ষাট ফিট মূল সড়কসংলগ্ন মধ্য পীরেরবাগে অপ্সরা হোমসের আরেকটি নির্মাণাধীন বহুতল ভবনের সন্ধান পাওয়া যায়। অপ্সরা সালমা গার্ডেন নামে ৩৪৮/২ মধ্য পীরেরবাগের বহুতল ওই ভবনটি নির্মাণকাজ প্রায় শেষের পথে। বাড়ির সামনে লাগানো সাইনবোর্ডে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে অপ্সরা হোমস লিমিটেড ও নির্মাণকারী ব্যক্তি হিসেবে তার স্ত্রী কুলসুমী আক্তার লিজার নাম লেখা রয়েছে। ভবনের তত্ত্বাবধায়ক জানান, এই ভূমির মূল মালিক মাহাবুবুর রহমান নামে এক ব্যক্তি। নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের হয়ে সবকিছু দেখভাল করেন আজহার নামে এক ব্যক্তি। আজহার বাবুর ভায়রা। ভবনের নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের অংশের একটি বাদে অন্য সব ফ্ল্যাট ইতিমধ্যে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অপ্সরা হোমস লিমিটেডের অধীনে ৫৩০/১ নম্বর পশ্চিম শেওড়াপাড়ায়ও একটি বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। অপ্সরা পান্থশালা নামে ওই ভবনটি কয়েক বছর আগে নির্মাণ করা হয়। ইতিমধ্যে ওই ভবনের সব ফ্ল্যাট বিক্রি হয়ে গেছে। এসব ছাড়াও মিরপুরের সেনপাড়া এলাকায়, উত্তরা, পূর্বাচল, ঝিলমিল ও উত্তরা তৃতীয় প্রকল্পে নামে-বেনামে তার একাধিক প্লট রয়েছে।
থমকে আছে দুদকের অনুসন্ধান
সংশ্লিষ্টরা জানান, বছর তিনেক আগে আলোচিত ও কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে বাবুর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কিন্তু অজানা কারণে তিন বছরেও সেই অনুসন্ধান শেষ করতে পারেননি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
দুদক সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ১৬ মার্চ দুদকের সহকারী পরিচালক মনিরুল ইসলাম অনুসন্ধান কর্মকর্তা হিসেবে শফিউল্লাহ বাবুকে একটি চিঠি পাঠান। কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর জালসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ শিরোনামে পাঠানো ওই চিঠিতে শফিউল্লাহ বাবু, তার স্ত্রী ও সন্তানের নামে সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য এবং অপ্সরা হোমস লিমিটেডের যাবতীয় ব্যাংক হিসাবসহ সব নথিপত্র দাখিল করতে বলা হয়। কিন্তু অজানা কারণে সেই অনুসন্ধান আর সামনে এগোয়নি।
দুদকের উপপরিচালক পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা জানান, ঘটনাটি এখনো অনুসন্ধান পর্যায়ে আছে। অনুসন্ধান শেষ হলে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনের মাধ্যমে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
নিজের এনআইডি কার্ডেও জালিয়াতি বাবুর
বাবু নিজের জাতীয় পরিচয়পত্রেও মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। সরকারি চাকরি করলেও বাবুর জাতীয় পরিচয়পত্র (৬৮৭০৬২১৮২৫) ঘেঁটে দেখা গেছে, সেখানে তিনি পেশা বেসরকারি চাকরি উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া জাতীয় পরিচয়পত্রে তার জন্মতারিখ ১৯৯০ সালের ১ জুলাই। তবে রাজউক থেকে পাসপোর্ট অধিদপ্তরে পাঠানো একটি অনাপত্তিপত্র-সংক্রান্ত নথিতে তার অবসরের সময় হিসেবে ২০৩৯ সাল উল্লেখ রয়েছে। সেই হিসাবে তার জন্মসাল হওয়ার কথা ১৯৮০ সাল।