আইএমএফের ঋণ: সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন জরুরি

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বোর্ড সভা গত ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশের জন্য ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন (৪৭০ কোটি) ডলার ঋণ মঞ্জুর করেছে। সাত কিস্তিতে ৪২ মাসে এ ঋণ দেয়া হবে। এ ঋণের গড় সুদের হার ২ দশমিক ২ শতাংশ। বর্ধিত ঋণসহায়তা বা বর্ধিত তহবিল (ইসিএফ/ইএমএফ) থেকে দেয়া হবে ৩৩০ কোটি ডলার এবং রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটির আওতায় পাওয়া যাবে ১৪০ কোটি ডলার। আইএমএফের প্রেস রিলিজে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষা, সামাজিক ও উন্নয়নমূলক ব্যয়ে আরও সক্ষমতা তৈরিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার, আর্থিক খাত শক্তিশালী করা, নীতি-কাঠামোর আধুনিকায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাতে জনগণকে সহনশীল করার কাজে এ ঋণ সাহায্য করবে।

এ ঋণ প্রদানের আগে আইএমএফ দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিধারা, সমস্যা ও দুর্বলতা পরীক্ষা করেছে এবং সরকারি ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছে। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাস, জনগণের জীবনমান উন্নয়ন, শিক্ষা বিস্তার, জনস্বাস্থ্য ও কৃষির উন্নয়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন, বিদ্যুতের ব্যবহার বৃদ্ধি, শিল্পোন্নয়ন, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ইত্যাদিতে যুগান্তকারী সাফল্য অর্জন করেছে। ১৯৭২ সালের শুরুতে যেখানে মানুষের মাথাপিছু আয় ৯০ ডলারের নিচে ছিল, তা বেড়ে ২ হাজার ৮২৪ ডলারে দাঁড়িয়েছে। ২০০৫ সালের ৪০ শতাংশ দারিদ্র্যের হার ২০১৯ সালে এসে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে নেমেছে। যেখানে ১৯৭৩ সালের জিডিপির আকার ছিল প্রায় ৮ বিলিয়ন, সেখানে ২০২২ সালে তা ৪৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। আইএমএফের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২২ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার সারা বিশ্বে ‘৩৫তম বৃহৎ অর্থনীতি’ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে (সূত্র: কানাডাস্থ ভিজুয়াল ক্যাপিটালিস্ট প্রকাশিত ‘দ্য টপ হেভি গ্লোবাল ইকোনমি’)।

আইএমএফ মনে করেছে যে করোনা মহামারি চলাকালে এবং মহামারির পর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রমে বাংলাদেশ ভালো করেছে। কিন্তু ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি, মন্দা ও জ্বালানিসংকটে বাংলাদেশ অর্থনীতিও চাপের মুখে পড়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি (৫২ বিলিয়ন ডলার) রেকর্ড পরিমাণ বাড়লেও আমদানি তুলনামূলক অধিক হারে বেড়েছে (৮৯ বিলিয়ন ডলার)। অন্যদিকে রেমিট্যান্স আসা তেমন বাড়েনি। ফলে বাণিজ্য ও লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতি দেখা দেয়। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত নেমে যেতে থাকে। ২০২১ সালের আগস্টে যে রিজার্ভ প্রায় ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছিল, তা নেমে ২৪ বিলিয়নে দাঁড়িয়েছে (২০২২-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত)। এ অবস্থায় তর্কের কোনো অবকাশ নেই যে বাণিজ্য ঘাটতি ও লেনদেনের ঘাটতি এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় বাংলাদেশের জন্য আইএমএফের সহায়তা প্রয়োজন।

নিঃসন্দেহে আইএমএফের এই সহায়তা বাংলাদেশের অর্থ ব্যবস্থাপনার ওপর তাদের আস্থারই বহিঃপ্রকাশ। তবে আইএমএফের শর্ত মোতাবেক বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে সংস্কারমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। যেমন রাজস্ব খাতে সংস্কার করে রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধি করতে হবে; যার মাধ্যমে সামাজিক খাত, অবকাঠামো উন্নয়ন, সরকারি অর্থায়ন ও বিনিয়োগ এবং জলবায়ু পরিবর্তন খাতে অধিক বরাদ্দ দেয়া সম্ভব হবে। আর্থিক খাত ও ব্যাংকব্যবস্থা সংস্কারের মাধ্যমে সুশাসন ও নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে। নীতি-কাঠামোগত সংস্কারের মাধ্যমে বাণিজ্য ও প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগের সহায়ক পরিবেশের সৃষ্টি করতে হবে। বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি কমিয়ে অর্থনীতির লোকসান কমানোরও পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এর ফলে জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়বে। বাজেটের ঘাটতি সীমিত রাখার কথাও বলা হয়েছে, যার মাধ্যমে দেশি-বিদেশি ঋণ গ্রহণ ও সরকারি অর্থ ব্যয়ে লাগাম টানা যায়।

তবে এই মুহূর্তে আইএমএফের সব শর্ত একসঙ্গে পালন না করলেও প্রস্তাবিত সংস্কারসমূহ বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, অনিয়ম দূর করে সুশাসন আনা এবং দেশের কর-জিডিপির অনুপাত বৃদ্ধি করে স্বনির্ভরতা আনার জন্য এসব সংস্কার বাস্তবায়নে দেশের অভ্যন্তরে সুশীল সমাজ ও অর্থনীতিবিদদেরও পরামর্শ রয়েছে। কৃষি, জ্বালানি ও গ্যাস-বিদ্যুতে ভর্তুকি পর্যায়ক্রমে কমিয়ে আনতে হবে। বৈশ্বিক মন্দা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সরবরাহ চেইনে বিপর্যয়, মূল্যস্ফীতি প্রভৃতির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ কতিপয় সমস্যার দিকেও আশু নজর দেয়া এবং প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।

More From Author

সেচের অভাবে পতিত ১৫০ বিঘা

এবার চোরের চরিত্রে তৌসিফ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *