লক্ষাধিক পুলিশ সদস্য রেশন-চিকিৎসাসেবা বঞ্চিত

পুলিশবাহিনীতে অবসরে যাওয়া সদস্যদের রেশন ও চিকিৎসা সেবা দেয়া নিয়ে দ্বৈতনীতির কারণে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে। ৯৯ ভাগ অবসরপ্রাপ্ত সদস্যই রেশন সুবিধার বাইরে থাকায় এক শতাংশের রেশন প্রাপ্তিতে তাদের দাবি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়নি বলে মনে করছেন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যদের দুটি সংগঠনের নেতারা। তাই অবসরপ্রাপ্ত শতভাগ সদস্যকে রেশন বরাদ্দের দাবি তুলেছেন তারা।

তিন বছর আগে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পুলিশ বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্যদের জন্য রেশন বরাদ্দ করে অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে অবসরে যাওয়া পুলিশ সদস্যদের এই সুবিধা দেয়া হয়। এর ফলে যারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই দাবি তুলেছিলেন তারাই এই সুবিধার বাইরে রয়েছেন, সংখ্যার বিচারে যারা ৯৯ ভাগ। তাদের দাবি, এই রেশন সুবিধা পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত শতভাগ সদস্যের জন্য বরাদ্দ দিতে হবে।

অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যদের দুটি সংগঠন হচ্ছে বাংলাদেশ অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার্স কল্যাণ সমিতি ও অনূর্ধ্ব সাব-ইন্সপেক্টর অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কল্যাণ অ্যাসোসিয়েশন। এই দুই সংগঠনের নেতাদের দাবি, স্বাধীনতার পর থেকে ২০২০ সালের আগ পর্যন্ত গত ৪৮ বছরে অবসরে যাওয়া লক্ষাধিক পুলিশ সদস্য অবসরকালীন রেশন সুবিধা ও চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাই বিষয়টি আবারও বিবেচনায় নিতে আহ্বান জানিয়েছে এই দুটি সংগঠন। এই দাবিতে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপির কাছে লিখিত অনুরোধ করেছেন উভয় সংগঠনের নেতারা।

অবসরে যাওয়া পুলিশ সদস্যরা দৈনিক বাংলাকে জানান, দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ৬ জানুয়ারি রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে অনুষ্ঠিত পুলিশ সপ্তাহ উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যদের জন্য আজীবন রেশন প্রদানের বিষয়টিও আমাদের সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে। আমরা সেটারও ব্যবস্থা করে দেব।’ তবে প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার পর সাড়ে তিন বছর পার হয়ে গেলেও তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।

তারা জানান, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে পুলিশ সপ্তাহ চলাকালে বিষয়টি নিয়ে আবারও প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। সে সময় অবসরপ্রাপ্তদের রেশন ও চিকিৎসা সুবিধা দেয়ার ঘোষণা বাস্তবায়নের জন্য তিনি আবারও নির্দেশ দেন।

সাবেক পুলিশ সদস্যরা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ওই ঘোষণার পর অর্থ মন্ত্রণালয় তড়িঘড়ি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পুলিশ সদর দপ্তরে সম্ভাব্য খরচের পরিমাণ জানতে চেয়ে চিঠি দেয়। পুলিশ সদর দপ্তর দেশের সব পুলিশ সুপারের মাধ্যমে সম্ভাব্য খরচসংক্রান্ত তথ্য অনুসন্ধান চালায়। পুলিশ সদর দপ্তর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অবসরকালীন পুলিশ সদস্যদের সংখ্যা ও খরচের হিসাব পাঠায়।

কর্মকর্তারা আরও জানান, ২০২০ সালের ২৯ জানুয়ারি অর্থ মন্ত্রণালয় অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যদের রেশন দেয়ার নির্দেশ দেয়; কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপন দেখে সারা দেশের কর্তব্যরত ও অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যরা হতাশ হয়ে পড়েন। জারিকৃত প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয় যে ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে যেসব পুলিশ সদস্যরা অবসরে গিয়েছেন, কেবল তাদের প্রত্যেক পরিবারের দুজন সদস্য রেশন সুবিধা পাবেন। এ ক্ষেত্রে দুজনের জন্য ২০ কেজি চাল, ২০ কেজি আটা, দুই কেজি চিনি, সাড়ে চার লিটার তেল ও দুই কেজি ডাল বরাদ্দ ঘোষণা করা হয়। এই আদেশ কার্যকর হওয়ার পর তা সংশোধন করে আরেক আদেশ জারি করা হয়। সেখানে চিনি ও ডালের পরিমাণ কমিয়ে দুই কেজির পরিবর্তে ১ কেজি নির্ধারণ করা হয়।

ফলে, আদেশে গত সাড়ে তিন বছরে অবসর যাওয়া পুলিশ সদস্যরাই কিছুটা উপকারভোগী হলেও এর আগে অবসরে যাওয়া লক্ষাধিক সদস্যের ভাগ্যে কিছু্ই জোটেনি।

২০২০ সালের আগে অবসরে যাওয়া একাধিক পুলিশ সদস্য জানান, একই পুলিশ বিভাগে এমন দ্বৈত নিয়ম চালু করায় ২০২০ সালের আগে ও পরে অবসরে যাওয়া পুলিশ সদস্যদের মধ্যে বৈষম্য ও অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। বৈষম্যের কারণে অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যগণ বিশেষ করে কনস্টেবল ও এসআই পদর্মযাদার পুলিশ সদস্যরা একদিকে যেমন রেশনসুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, অন্যদিকে পুলিশ হাসপাতালে সার্বজনীন চিকিৎসাসেবা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন।

অনুর্ধ্ব সাব- ইন্সপেক্টর অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কল্যাণ অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মো. আনিচুর রহমান হাওলাদার দৈনিক বাংলাকে বলেন, পুলিশ বাহিনীতে আমরা কম বেতনে চাকরি করছি। কম দামের রেশন পেয়েছি। পেনশনও কম পেয়েছি। এজন্য আমরাই সুযোগ সুবিধার দাবি করছি দীর্ঘদিন ধরে। অথচ আমাদেরকেই বঞ্চিত করে অর্থ মন্ত্রণালয় নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করে। এতে লক্ষাধিক সদস্য মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

তিনি আরও বলেন, একই বাহিনীতে এমন দ্বৈত নিয়ম বাতিল করে সুবিধাবঞ্চিত সকল অবরসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যদের অবসরকালীন পারিবারিক পেনশনের দাবিতে আমরা প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করার প্রস্তুতি নিয়ে এগুচ্ছি।

পুলিশের বিভিন্ন পদমর্যাদার একাধিক কর্মকর্তা জানান, ১৯৭২ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বেঁচে থাকা অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যদের সংখ্যা প্রায় এক লাখ। এদের মধ্যে ৯০ হাজার সদস্যই হলেন কনস্টেবল থেকে এসআই পদ মর্যাদার সদস্যরা। যারা কর্মজীবনে স্বাধীনতা যুদ্ধ ও পরবর্তী যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন, দেশের অভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, জঙ্গি কার্যক্রম ও অবৈধ মাদক নির্মূল ক্ষেত্রে অকুতোভয় দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে সর্বপ্রথম পুলিশই পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। ৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারকে রক্ষা করতে গিয়ে এদেরই অনেক সদস্য নিহত হন।

সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যদের একটি অংশের রেশন চালু করায় একই বিভাগে দ্বৈতনীতির সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে অবসরে যাওয়া সিংহভাগ সদস্যই রেশন পাচ্ছেন না, সংখ্যার বিচারে যারা ৯৯ ভাগ। অন্যদিকে মাত্র ১ ভাগ অবসরপ্রাপ্ত সদস্য রেশন সুবিধা পাচ্ছেন।

More From Author

ইসরায়েলে বন্ধ হতে চলেছে আলজাজিরা

ভারতে প্রিয়তমার দুদিন আগেমুক্তি পাবে টাইগার থ্রি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *