‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই/ কোথায় হারিয়ে গেল সোনালি বিকেলগুলো সেই’—গুনগুন করে গানটা গাননি বা শোনেননি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। গানটির গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসের আড্ডাকে উপজীব্য করে লেখা গানটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শুনলে উপলব্ধি করা যায় কফি হাউসের হারানো আড্ডা, দূর পৃথিবীতে থাকা বন্ধু আর আহত কিছু স্মৃতি এ গানে বেঁধেছেন তিনি। তবে কেবলই কি হারানো সময়ের বিবরণ ও স্মৃতিকাতরতাকে গানের ফ্রেমে বেঁধে রাখা ছিল তাঁর উদ্দেশ্য, নাকি গানটি রচনার পেছনে আছে কোনো গল্প?
গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ও নচিকেতা ঘোষ দুজনে ছিলেন বন্ধু। কেবল বন্ধু বললে কম বলা হবে, তাঁরা ছিলেন হরিহর আত্মা। কলেজজীবন থেকে বন্ধুত্ব তাঁদের। জীবনভর বন্ধুত্বের ভার বহন করেছেন দুজনে। কথা-কাটাকাটি, তর্ক-বিবাদ কোনো দিন যে হয়নি, ব্যাপারটা তেমন নয়। দুজনের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক হয়েছে; কিন্তু তা কেবল গান নিয়ে, গানের জন্য। দুজনই ছিলেন গানপাগল মানুষ। একজন সুরকার, সংগীত পরিচালক, আরেকজন গীতিকার।
‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে’; ‘না না না, আজ রাতে আর যাত্রা শুনতে যাব না’র মতো অনেক আলোচিত গান রচনা করেছেন দুজন। তবে শুধু গান রচনা পর্যন্ত তাঁদের বন্ধুত্ব সীমাবদ্ধ ছিল না। দুই পরিবারের মধ্যেও ছিল ভালো সম্পর্ক। নচিকেতার মতো তাঁর পরিবারের সবাইও ভালোবাসতেন গৌরীপ্রসন্নকে। গান তৈরির কাজে তো যেতেনই, তা ছাড়া অবসরের অনেকটা সময়ও তিনি বন্ধুর শ্যামবাজারের বাড়িতে কাটাতেন। বন্ধুপুত্র সুপর্ণকান্তিকে পুত্রের মতো স্নেহ করতেন গৌরীপ্রসন্ন।
আরও পড়ুনঃ শারীরিক চাহিদা মেটানোই সব নয়, জীবনের পরিধি অনেক বড় : এ আর রহমান
সুপর্ণকান্তি বড় হলেন। তখন চারদিকে বাবা নচিকেতা ঘোষের জয়জয়কার। তিনিও বাবার পথে হাঁটবেন বলে মনস্থির করলেন। শুরু হলো সুর সাধনার কাজ। তখন মাত্র কয়েকটি গানের সুর করেছেন। একদিন বাড়ি ফিরতে দেরি হওয়ায় গৌরীপ্রসন্নের প্রশ্নের মুখে পড়লেন। সেদিন গান তৈরির কাজে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার তাঁদের বাড়িতে ছিলেন। ঘরে ঢুকতেই প্রশ্ন করলেন, ‘কী, বাইরে আড্ডা মেরে সময় কাটাচ্ছ?’ কথা এগোতে এগোতে অনেক দূর এগোল। একপর্যায়ে সুপর্ণকান্তি কফি হাউসের আড্ডা নিয়ে গান লেখার জন্য চ্যালেঞ্জ করলেন গৌরীপ্রসন্নকে। তিনিও কম যান না, চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে লিখতে শুরু করলেন। বিবিসির শ্রোতা জরিপে শ্রেষ্ঠ বাংলা গানের খেতাব পাওয়া গানটির প্রথম দুই চরণ, ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই/ কোথায় হারিয়ে গেল সোনালি বিকেলগুলো সেই’ রচিত হলো কয়েক মুহূর্তেই। তবে সম্পূর্ণ গানটি সময় নিয়েই রচনা করেছিলেন গৌরীপ্রসন্ন।
এবার অঞ্জন দত্তের ‘বেলা’র কাছে যাওয়া যাক। বেলা মানে ‘এটা কি ২৪৪-১১-৩৯’। গানের কোনো চরিত্র যে এতটা জনপ্রিয় হতে পারে অঞ্জন দত্ত গানটা না বানালে উপলব্ধি করা কঠিন ছিল।
গানে যে গল্প অঞ্জন দত্ত লিখেছেন, তা কি তাঁর নিজের জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা? সত্যিই কি গানে নিজের জীবনের গল্প লিখেছেন অঞ্জন দত্ত? উত্তরটা হলো একদমই না। হিন্দুস্তান টাইমসকে এমনই বলেছিলেন অঞ্জন দত্ত। জানিয়েছিলেন, প্রেমে পড়ে কিংবা কাউকে ভালোবেসে এই গান তিনি লেখেননি। ‘দুটি মানুষের প্রেমের কথা ভেবেই এই গান তৈরি করেছিলাম।’ স্পষ্ট জবাব ছিল তাঁর।
তবে গানে যে ফোন নম্বর ‘২৪৪-১১-৩৯’ এটা কিন্তু কাল্পনিক নয়। এটা ছিল একটি খবরের কাগজের অফিসের নম্বর। অজস্র ফোন পেতে পেতে কাগজের এডিটর নাজেহাল হয়ে উঠেছিলেন। লোকেরা ফোন করে বলতেন, ‘বেলাকে ডেকে দিন না একটিবার’। শেষমেশ বাধ্য হয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তাঁরা। এ ঘটনায় অঞ্জন দত্তের বাবাও রেগে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, পাবলিক নুইসেন্স অ্যাক্টে ছেলের শাস্তি হওয়া উচিত। এরপর অবশ্য ক্ষমা চেয়েছিলেন অঞ্জন দত্ত। শেষমেশ ওই ফোন নম্বর আজীবনের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।