মণ প্রতি পাটের দাম কমেছে ৬০০, আবাদে বেড়েছে খরচ

দেশে পাট চাষের ওপর বরাবরই গুরুত্ব দিয়ে আসছে সরকার। কিন্তু বগুড়ার মাঠে চিত্র ভিন্ন। উপযুক্ত দামের অভাবে কৃষক পাট চাষে আগ্রহ হারাচ্ছে। গেল বছরের চেয়ে এবার মণ প্রতি পাটের দাম কমেছে অন্তত ৬০০ টাকা। এদিকে পাট আবাদে  কৃষকের খরচ বেড়েছে।

আবার রপ্তানি না থাকায় পাইকারি ব্যবসায়ীরাও পাট ক্রয় করে পড়ছেন লোকসান ঝুঁকিতে। এমন পরিস্থিতিতে আগামীতে পাটের আবাদ ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছেন কৃষকেরা।

বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যেও দেখা যায়, জেলায় পাট চাষের পরিমাণ কমেছে। এবার উৎপাদন বেশি হলেও গত দু’বছর ধরে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি এই অর্থকরী ফসলে। তবে জেলার কৃষি কর্মকর্তারা সোনালী আঁশ উৎপাদনে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে নিয়মিত প্রণোদনা দিয়ে যাচ্ছেন।

জেলা কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে বগুড়ায় পাট চাষে জমির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১২ হাজার ৬৩৪ হেক্টর। বিপরীতে অর্জন হয় ১০ হাজার ৬৯০ হেক্টর। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩০ হাজার ৫১৭ মেট্রিক টন। জমি থেকে ফসল কাটা এখনও চলমান। তবে অর্জিত জমিতে উৎপাদনের হার পাওয়া যাচ্ছে ২ দশমিক ৮২ মেট্রিক টন করে। এ হিসাবে মোট উৎপাদন হতে পারে প্রায় ৩০ হাজার ১৪৬ মেট্রিক টন।

গত অর্থবছরে পাটের আবাদে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। ১৩ হাজার ৫০ হেক্টর জমির বিপরীতে অর্জন হয়েছিল ১১ হাজার ১৬৭ হেক্টর। আর উৎপাদন পাওয়া যায় ৩০ হাজার ৬৭৬ মেট্রিক টন।

এসব গেল পরিসংখ্যানের কথা। মাঠ পর্যায়ে কৃষকও বলছে পাটের উৎপাদন বৃদ্ধির কথা। বন্যা না থাকায় এবার ফলনে সমস্যা হয়নি। কিন্তু জমি থেকে পাট কাটার পর হাট-বাজারে পাটের দাম দেখে হতাশ তারা। গেল সপ্তাহে পর্যন্ত প্রতি মণ পাট বিক্রয় হয়েছে ১৮শ থেকে দুই হাজার টাকায়। তবে দু তিন দিন ধরে এই দাম একটু বেড়েছে। 

বগুড়ার সারিয়াকান্দির মথুরাপুর হাটে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিমণ পাট কৃষকেরা বিক্রি করছেন ২২শ থেকে ২৪শ টাকায়। বগুড়ার সবচেয়ে বেশি পাট চাষ হয় এই উপজেলায়, এবারের পরিমাণ ৫ হাজার ৭১৫ হেক্টর। এ জন্য এখানে আশপাশের অনেক পাইকার আসেন পাট ক্রয় করতে।

তবে এসব দামে কৃষক সন্তুষ্ট নয়। তাদের দাবি, দুই হাজার বা ২৪শ টাকায় পাট বিক্রয় করে তাদের খরচ পোষাচ্ছে না। পাট চাষে অন্য খরচ তেমন না থাকলেও কৃষি মজুরের খরচ বেশি। প্রতি বিঘায় চাষ থেকে শুরু করে পাট ঘরে তুলতে তিন দফায় অন্তত ১৪ জন শ্রমিক প্রয়োজন। শ্রমিক প্রতি এবার দিতে হয়েছে ৬০০ টাকা। আনুষঙ্গিক খরচ মিলে প্রতি বিঘা পাট চাষে খরচ পড়ে প্রায় ১০ হাজার টাকা। আবার হাটে আনা নেওয়াতেও খরচ আছে।

সারিয়াকান্দি উপজেলার দেবডাঙ্গা গ্রামের এনামুল হক বলেন, আমার ১০০ শতক জমিতে সব মিলিয়ে খরচ হয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার টাকা। এখন দাম যাচ্ছে ১৮শ থেকে দুই হাজার টাকা মণ। এই দামে খরচ উঠবে না। এ রকম থাকলে আগামীতে এই ফসল আর করা যাবে না।

উপজেলার উল্যাডাঙ্গা গ্রামের লেবু প্রামানিক তিন বিঘা জমিতে পাট করেছেন। এর মধ্যে দুই বিঘা জমির পাট কেটে শুকাচ্ছেন। লেবু প্রামানিক বলেন, পাট এভাবে করা যাবি না। খরচা বেশি। কাটতে লাগে ৬০০ টাকা, উবাতে ৬০০, ধুইতে লাগে ৬০০ টাকা। বাজারে দাম নাই। এখন বীজ, সারের দাম বেশি। আগে তো ১০০ টাকা মণ পাটও বেচছি। তখন ওই দামে খরচ পোষাতো। কিন্তু এখনতো খরচে পোষায় না।

মথুরাপাড়া হাটে নয় মণ পাট নিয়ে এসেছেন সারিয়াকান্দির শনপচা চরের বাসিন্দা শামসুজ্জোহা মণ্ডল। এর মধ্যে ছয় মণ পাট ২৪শ টাকায় বিক্রি করেছেন। দাম কম বলায় বাকি তিন মণ পাট দিচ্ছেন না। 

এই কৃষক বলেন, এবার পাট ভালোই হছলো, কিন্তু কামলার মনায় (শ্রমিক খাত), নামেনি, ধোয়াতেই ঘর থেকে ভর্তুকি গেছে।

রোববার মথুরাপাড়া হাটে পাট ক্রয় করতে এসেছেন ধুনট উপজেলার সোনামুখী গ্রামের পাইকারি ব্যবসায়ী সোহাগ বাবু। তিনি বলেন, আজকের বাজারে পাটের দাম একটু বেশি। ২৩শ থেকে ২৪শ টাকা পাট ক্রয় করছি। সরকার গত বছর পাট নেয়নি। গত বছর পাটের দাম ৩২শ থেকে ৩৩শ টাকা ছিল। অনেকে কিনে রাখছিল, কিন্তু বেচতে পারেনি। এ জন্য এবার দাম ২২শ-২৩শ টাকা হয়। এবারও সরকার পাট না নিলে দাম আরও কমে যাবে। সরকার যদি পাট দেশের বাইরে পাঠানোর ব্যবস্থা করে, তাহলে কৃষকের ভালো হবে। আমাদেরও ভালো। 

মথুরাপাড়া হাটের আরেক পাইকারি ব্যবসায়ী মো. সুজন জানান, বিগত চার থেকে পাঁচ বছর সরাসরি পাট রপ্তানি বন্ধ আছে।   

এই পাইকার বলেন, বিগত দুই তিন বছরের মধ্যে এবার পাটের মান ভালো। তবে পাটে যেমন খরচ হয় সেটা বিক্রয়ের দামে ওঠে না। আর আমরা কৃষকদের দিতে পারছি না, আসলে আমরা তো পাট নিয়ে বিক্রি করি। যদি আমরা ন্যায্য দাম পেতাম, তাহলে তাদেরকেও আমরা ভালো রেট দিতে পারতাম। 

পাটের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সরকার বদ্ধ পরিকল্প। এ লক্ষ্যে চলতি বছরে বগুড়ায় ১০ হাজার কৃষককে প্রণোদনা হিসেবে এক কেজি করে বীজ দেওয়া হয়েছে বলে জানান জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মতলুবর রহমান। 

তিনি বলেন, মৌসুমের শুরুতে বৃষ্টিপাত কম ছিল বিধায় পাট চাষিদের কিছুটা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তবে মৌসুমের মাঝামাঝিতে এসে পর্যাপ্ত বৃষ্টি হওয়ায় পাট পচানোর কাজ সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছে কৃষকেরা। তবে এবার ফলন ভালো হয়েছে। বিঘা প্রতি প্রায় ৯ মণের বেশি উৎপাদন হয়েছে। বর্তমানে পাটের মান ভেদে প্রতি মণে ২ হাজার থেকে ২৫শ টাকা দাম পাওয়া যাচ্ছে। 

দাম কমের বিষয়ে এই কৃষিবিদদের পরামর্শ, এখন সবেমাত্র জমি থেকে পাট কাটা শুরু হচ্ছে, এখন বাজারে বিক্রি না করে কিছুদিন সংরক্ষণ করা ভালো। তাহলে মাসখানেক পর পাটের বাজার চাঙ্গা হলে কৃষকরা ভালো দাম পাবেন।

রপ্তানির প্রসঙ্গে উপপরিচালক মতলুবর রহমান বলেন, আমাদের দেশে বেসরকারি পর্যায়ে বেশ কিছু পাটের কল আছে, যারা কিনা পাটজাত দ্রব্য যেমন বস্তা তৈরি করে রপ্তানি করছে। যদি এই পাট রপ্তানিটা সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে আরও বাড়ানো যায় তাহলে আমাদের কৃষক ভাইয়ের যথেষ্ট ভালো দাম পাবে। এই যে একটা ভালো ফসল যা কিনা মাটির উর্বরতা বাড়ায় সেই ফসল চাষে কৃষকরা আরও উদ্বুদ্ধ হবে।

পাট রপ্তানির বিষয়ে কথা হয় বগুড়া চেম্বার অব কমার্সের সহ সভাপতি মাহফুজুল ইসলাম রাজ। তিনি বলেন, বগুড়ায় যে-সব মিল-কারখানা আছে তারা পাটের ফিনিশড গুড (পাটজাত দ্রব্য) ইন্ডিয়াতে রপ্তানি করে থাকে। ইন্ডিয়াতে পাটের বিশাল মার্কেট রয়েছে। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্য ও অনেক দেশেই আমাদের পাটের ফিনিশড পণ্য যায়।

আমরা বিশ্বাস করি কৃষকদের প্রণোদনার হার বাড়িয়ে দেয় এবং যে ফিনিশড গুড রপ্তানি হয় সেদিকে সরকার একটু সুনজর দেয়, আরও প্রণোদনার হার বাড়িয়ে দেয় আগামীতে পাটে আরও বৈদেশিক মুদ্রা আসবে। 

সরাসরি পাট রপ্তানির সুযোগ নিয়ে মাহফুজুল হক রাজ বলেন, সরাসরি পাট বহির্বিশ্বে আমরা বাইরে রপ্তানি করতে চাই, সেখানে পাটের ময়েশ্চারসহ রপ্তানির যে জায়গাগুলো আমাদের ফুলফিল করার দরকার, সেটি কৃষকের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। এটি বড় ব্যবসায়ীরা যারা সরাসরি পাট রপ্তানি করেন তারা পারেন। কিন্তু সেক্ষেত্রে কৃষকরা সত্যিকার অর্থে লাভবান হবেন না। আমরা যেটি বিশ্বাস করি, আমাদের উৎপাদিত পাটকে কোনো পণ্য বানিয়ে রপ্তানি করি, তাহলে বৈদেশিক মুদ্রা যেমন বেশি আয় হয়। পাশাপাশি কৃষককের উৎপাদিত পাট রপ্তানির ক্ষেত্রে যে-সব বাধা থাকে তা পার হতে হয় না।

More From Author

তাপমাত্রা কমবে, প্রশমিত হবে তাপপ্রবাহ

ডিপজলের কাছ থেকে গরু উপহার পেয়েছেন শিরিন শিলা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *