৭ বছরেও বাজারে এল না ‘সোনালি ব্যাগ’

বাংলাদেশের সোনালি আঁশ পাটের ‘সোনালি দিন’ ফিরে আসার হাতছানি দেখা দিয়েছিল ২০২০-২১ অর্থবছরে। ওই অর্থবছরে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ১১৬ কোটি ১৫ লাখ (১.১৬ বিলিয়ন) ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে রপ্তানি তালিকায় চামড়াকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছিল এই খাত। আগের অর্থবছরের (২০১৯-২০) চেয়ে রপ্তানি বেড়েছিল ৩১ দশমিক ৬৩ শতাংশ। কিন্তু গত ২০২১-২২ অর্থবছরে এসে হোঁচট খায়, রপ্তানি নেমে আসে ১১২ কোটি ৭৬ লাখ ডলারে। আগের অর্থবছরের চেয়ে কমে প্রায় ৩ শতাংশ।

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে অবস্থা আরও খারাপ। প্রধান রপ্তানি পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা পাট খাতের। অর্থবছরের প্রথম আট মাসে অর্থাৎ জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি থেকে আয় কমেছে ২৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এই আট মাসে এই খাত থেকে ৬১ কোটি ডলার আয় হয়েছে। নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কমেছে প্রায় ২৬ শতাংশ। জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে এই খাত থেকে আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ১২৮ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে আয় হয়েছিল ৮০ কোটি ডলার।

এদিকে উদ্ভাবনের পর সাত বছর পেরিয়েছে, এখনো বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আসেনি বেশ আলোড়ন তোলা এবং আশা জাগানিয়া পাট থেকে তৈরি পলিথিন ব্যাগ, যার নাম দেয়া হয়েছে ‘সোনালি ব্যাগ’। পরিবেশবান্ধব এই ব্যাগের বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য একটি পাইলট প্রকল্প নেয়া হয়েছিল। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই। ব্যাগের সীমিত উৎপাদন সম্ভব হয়েছে কেবল। কিন্তু সোনালি ব্যাগ বাজারে আসবে কবে? আদৌ কি তা আসবে? এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) কোনো কর্মকর্তা নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছেন না।

এমন পরিস্থিতিতেই আজ ৬ মার্চ সোমবার পালিত হচ্ছে জাতীয় পাট দিবস। ‘পাট শিল্পের অবদান-স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে এবার পালিত হচ্ছে দিবসটি। ২০১৭ সালের ৬ মার্চ থেকে প্রতিবছর বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পাট দিবস পালিত হয়ে আসছে।

এদিকে পাটকে কৃষিজাত পণ্য হিসেবে গণ্য করার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে এটি দৃঢ়ভাবে বাস্তবায়ন করতেও সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন তিনি। এর ফলে কৃষিঋণসহ কৃষিজাত পণ্যের ক্ষেত্রে যেসব সুবিধা দেয়া হয়, পাটের ক্ষেত্রেও তা দেয়া হবে। গত ৯ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী এ নির্দেশ দেন। ওই বৈঠকে জাতীয় কৃষি বিপণন নীতির খসড়া অনুমোদন দেয়া হয়। এই নীতি নিয়ে আলোচনার সময় প্রধানমন্ত্রী পাট নিয়ে এই নির্দেশনা দেন।

বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে পাটের আঁশের ব্যবহার অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এ জন্য অনেক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, এখন থেকে পাট হবে কৃষিজাত পণ্য। এ জন্য পাট এখন থেকে কৃষিজাত পণ্য হিসেবে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাবে। এত দিন অনেক সময় পাটকে শিল্পজাত পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হতো বলে জানান তিনি। এ ছাড়া রপ্তানির সুবিধার্থে এবং আধুনিক করার জন্য কৃষিজাত পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের বিষয়ে একটি নীতিমালা করতে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন বলেন জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

নির্ভরযোগ্য বিকল্পের অভাবে বাজার সয়লাব নিষিদ্ধ পলিথিনে। মাঝে হাতে ঝুলিয়ে ব্যবহার উপযোগী পলিথিন ব্যাগ বন্ধ ছিল। এখন সেই ব্যাগও বাজারে ফেরত এসেছে। কাঁচাবাজার, মুদি দোকান, শপিংমল, চেইন শপ- সব জায়গায় পলিথিনের ব্যবহার বাড়ছে। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এই পণ্য নিয়ন্ত্রণে মাঝে মাঝে অভিযান চালানো হয়, কিন্তু তাতে পলিথিনের ব্যবহার কমেনি।

বাংলাদেশে পলিথিন নিষিদ্ধ হয় ২০০২ সালে। পরিবেশবিদরা বলছেন, আইনের প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের ব্যর্থতার কারণেই পলিথিন থেকে মুক্তি মিলছে না। শুধু বাংলাদেশ নয়, পলিথিন নিয়ে চিন্তিত সারা বিশ্ব। প্রতিদিন লাখ লাখ টন পলিব্যাগ ব্যবহৃত হচ্ছে, বর্জ্য হিসেবে তা পরিবেশ দূষণ করছে।

বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আসার আগেই ‘সোনালি ব্যাগ’ দেশে-বিদেশে বেশ সাড়া ফেলেছিল। ব্যাগটি বাজারজাত করতে ২০১৮ সালে একটি পাইলট প্রকল্প নেয়া হয়। তবে সেই ব্যাগ সাত বছরেও বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আনা যায়নি। ঢাকার ডেমরার শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম তীরে সরকারি পাটকল লতিফ বাওয়ানী জুট মিল। সেখানেই সোনালি ব্যাগ তৈরির কারখানা। ২০১৯ সালের ৭ এপ্রিল বাংলাদেশ জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড থেকে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয় এই ব্যাগ উৎপাদনের জন্য। ওই টাকা দিয়ে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও রাসায়নিক দ্রব্য কেনা হয়েছে। এরপর কাজ আর তেমন এগোয়নি।

পাঁচ বছর আগে বাংলাদেশি বিজ্ঞানী মোবারক আহমেদ খান জানিয়েছিলেন, পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তিনি খুব দ্রুতই এ ব্যাগের বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে পারবেন। কিন্তু সেই পৃষ্ঠপোষকতা মেলেনি, তাই বাজারজাত করাও সম্ভব হচ্ছে না। উদ্ভাবক মোবারক আহমেদ এখন বলছেন, ‘আমরা জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট থেকে যে টাকা পেয়েছিলাম তা দিয়ে কাজ করছি। এটা বাজারে আসতে অনেক সময় লাগবে। আমরা ২০১৭ সালের মাঝামাঝি থেকে শুরু করেছি। আমাদের কোনো মেশিন ছিল না। নিজেরা মেশিন বানিয়েছি।

গত রোববার তিনি দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘আমরা এখন অটোমেটিক মেশিনে বানাচ্ছি। মিনিটে ৪১টা ব্যাগ তৈরি হচ্ছে। এখন বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আনতে হলে এটা বড় আকারে করতে হবে। আমাদের পাইলট প্রকল্প শেষ। এটা রাউন্ড দ্য ক্লক চালাতে হবে সেখানে চলে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা। বিদ্যুৎ পাওয়া যায় না। বাণিজ্যিক না হওয়ার বড় কারণ মেশিন। এটার ডিজাইন কেমন হবে সেটাও বাধা। আর সবচেয়ে বড় বাধা এটা মার্কেটে কীভাবে ঢুকবে। পলিথিনের একটা বড় বাজার রয়েছে। আর জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতার অভাব। সরকারের কাছে অর্থ চাওয়া হয়েছে উল্লেখ করে মোবারক বলেন, ‘সরকারের সদিচ্ছার ঘাটতি নেই। তবে ব্যবস্থাপনার অভাব আছে, মার্কেটিংয়ের অভাব আছে আর লোকবলের বেশি অভাব। সব কিছুই নির্ভর করছে আসলে সরকারের ওপর।’

বিজেএমসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাণিজ্যিকভাবে সোনালি ব্যাগ বাজারে আনার ক্ষেত্রে মূল জটিলতা এখন একটি স্বয়ংক্রিয় (অটোমেটেড) ব্যাগ সিলিং মেশিন কেনা, আর দরকার বড় আকারের অর্থায়ন।

উদ্যোগ আছে, বাস্তবায়ন নেই

২০১৫ সালে আওয়ামী লীগ সরকার বাজারে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার কমাতে আবারও উদ্যোগ নেয়। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সে বছর ও ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ধান, চাল, ভুট্টা, সার, চিনিসহ ১৯টি পণ্যের মোড়ক হিসেবে প্লাস্টিক বা পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। তখন কিছু অভিযানও চালানো হয়। কিন্তু জনবল ও তদারকির অভাবে অভিযানের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়নি। ফলে সরকারের সে উদ্যোগের সুফল আর মেলেনি।

বিজেএমসি উৎপাদনে নেই, রপ্তানিও নেই

বছরের পর বছর লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে ২০২০ সালে ১ জুলাই সরকার বিজেএমসির ২৫টি পাটকল বন্ধ করে দেয় সরকার। রাষ্ট্রায়ত্ত কোনো পাটকল এখন উৎপাদনে নেই। সে কারণে সরকারিভাবে পাট ও পাটজাত পণ্য এখন আর রপ্তানি হয় না। অথচ বন্ধ হওয়ার আগে বিজেএমসির পাটকলগুলো থেকে এ খাতের রপ্তানির ২০ শতাংশের মতো আসত।

ম্যান ইউনাইটেডকে ৭ গোলে আর লজ্জায় ভাসিয়ে লিভারপুলের রেকর্ড

১৩০০ কর্মী ছাঁটাইয়ের মাস না যেতেই বরখাস্ত জুম প্রেসিডেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *