বাংলাদেশ অনড় কয়লার বাড়তি দাম না দিতে

ঢাকায় এসে আদানি জানাল চুক্তি পরিবর্তন হবে না

বাংলাদেশের সঙ্গে করা আদানির চুক্তির পরিবর্তন করবে না ভারতের এই শিল্পগ্রুপটি। চুক্তিতে যেসব শর্ত রয়েছে, সেই শর্তেই বাংলাদেশকে ঝাড়খন্ডের গোড্ডা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে হবে। তবে বাংলাদেশ বাড়তি দামে কয়লা কিনবে না, আদানিকে কয়লার দাম কমানোর একটি পদ্ধতি বের করতে হবে।

কয়লার দাম নিয়ে জটিলতা নিরসনে আদানি পাওয়ারের চার সদস্যের এক প্রতিনিধি দল গত ২৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে আসে। তাদের সঙ্গে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কর্মকর্তা ও বিদ্যুৎ সচিবের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেন। বৈঠক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

গত জানুয়ারিতে আদানি প্রতি টন কয়লার দাম ৪০০ ডলারে আমদানি করার জন্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কাছে চাহিদাপত্র পাঠালে শুরু হয় জটিলতা। দেশে চালু থাকা তিনটি কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র গড়ে ১৫০ থেকে আড়াই ডলারে কয়লা কিনছে।

গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বিদ্যুৎ ভবনে পিডিবির কর্মকর্তাদের সঙ্গে আদানির চার কর্মকর্তা আলোচনায় বসেন। পিডিবির পক্ষে নেতৃত্ব দেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান ও আদানির পক্ষে নেতৃত্ব দেন আদানি পাওয়ার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অনিল সারদানি। বিকেলে বৈঠক করেন বিদ্যুৎ সচিবের সঙ্গে। তারপর ওইদিন সন্ধ্যার ফ্লাইটে তারা ভারতে ফিরে যান।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল রাতে টেলিফোনে দৈনিক বাংলাকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, আদানির প্রতিনিধিরা ঢাকায় এসেছিল, আমাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি বা কয়লার মালিক আমরা। আমরা প্রতিযোগিতামূলক দামে কিনব। কয়লার দাম বাড়তি দেয়া হবে না বলেও তিনি জানান।

আদানি চুক্তি পরিবর্তন করবে না: পিডিবির সঙ্গে করা আদানির চুক্তির কোনো পরিবর্তন করবে না আদানি। বৈঠকে উপস্থিত দুই কর্মকর্তা দৈনিক বাংলাকে বলেন, আদানির প্রতিনিধিরা বৈঠকে বলেছেন তারা ভারতের পাওয়ার ফাইন্যান্স করপোরেশন ও আরইসির কাছ থেকে পিডিবির সঙ্গে করা বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি (পাওয়ার পারচেজ অ্যাগ্রিমেন্ট বা পিপিএ) জমা দিয়ে ঋণ পেয়েছে। এখন কোনোভাবেই পিপিএ সংশোধন করা যাবে না। কারণ এই পিপিএ দেখিয়েই তারা ঋণ পেয়েছে।

তারা বলেন, যেহেতু আদানি বাংলাদেশের সঙ্গে করা লাভজনক পিপিএ দেখিয়ে ঋণ নিয়েছে, সে কারণে তারা পিপিএ সংশোধন করতে পারবে না। তবে তাদের ঋণ চুক্তিতে কী কী শর্ত আছে সেটা পিডিবি জানে না, পিডিবিকে তারা ঋণ চুক্তির শর্ত সম্পর্কেও অবহিত করেনি।

বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়, চুক্তি অনুযায়ী কয়লার দাম তারা ধরেছে ইন্দোনেশিয়ার ৪৬০০ ক্যালরিফিক মানের কয়লার সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার নিউ ক্যাসেলের ৬২৩০ ক্যালরিফিক মানের কয়লা। এ দুটির গড় দাম ধরে কয়লার দাম নির্ধারণ করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে আদানি কয়লা আনছে ৪৬০০ ক্যালরিফিক মানের কয়লা। এ ক্ষেত্রে আদানি কয়লার দামের ওপর ডিসকাউন্ট দিতে পারে। কারণ কয়লা খনিও আদানির নিজের।

পিডিবির কর্মকর্তারা আরও বলেন, বৈঠকে আমরা বলেছি বাংলাদেশের পায়রায় ৪৫ শতাংশ ডিসকাউন্ট পাচ্ছে কয়লা কেনার সময়। ৪৫ শতাংশ না হলেও অন্তত ৪০ শতাংশ ডিসকাউন্ট দেয়া হোক বলে আদানির কর্মকর্তাদের তারা জানিয়েছে।

পিডিবির এই প্রস্তাবের বিষয়ে আদানির কর্মকর্তারা বলেছেন, এই প্রস্তাবটি নিয়ে আলোচনা হওয়ার সুযোগ রয়েছে। আমরা এটি নিয়ে কথা বলতে পারি। সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে আমরা এই বিষয়ে একটি সমাধানে আসতে পারব।

প্রসঙ্গত, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র ৫০৫০ ক্যালরিফিক মানের কয়লা প্রতি টন কিনছে ১১০ ডলারে। আর জাহাজ ও অন্যান্য ব্যয় মিলিয়ে কেন্দ্র পর্যন্ত এটি আনতে আরও ৪০ ডলার খরচ হচ্ছে। সব মিলিয়ে প্রতি টন কয়লায় পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের পড়ছে ১৫০ ডলার। অবশ্য এর মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার খনি কর্তৃপক্ষ পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ৪৫ শতাংশ ডিসকাউন্ট দিয়েছে। রামপাল ও এস আলমের বিদ্যুৎকেন্দ্রে গড়ে ২৫০ থেকে ২৬০ ডলার প্রতি টনের দাম পড়ছে।

চুক্তিতে যা আছে: আদানির সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী তাদের গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম করলে প্রতি ইউনিটে কয়লাও বেশি দেয়া হয়েছে। অথচ অন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হোক বা বেশি হোক কয়লার পরিমাণ সমান রাখা হয়েছে। দেশে স্থাপিত অন্য কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র থেকে ইউনিটপ্রতি প্রায় ৬২ গ্রাম কয়লার দাম বেশি নিয়েছে আদানি। এতে আদানির দেয়া কয়লার দাম অনুসারে বর্তমানে অন্তত ৬ হাজার কোটি টাকা বাড়তি পাবে তারা।

ক্যাপাসিটি পেমেন্ট পেয়েছে আদানি ৫ দশমিক ৪০২৭ টাকা, এটি দেশে যত বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে তার মধ্যে সর্বোচ্চ। তেল ও গ্যাসভিত্তিক বেসরকারি কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি পেমেন্ট ৮০ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ১ দশমিক ২০ টাকা। আর কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি পেমেন্ট আড়াই টাকা থেকে সাড়ে চার টাকা পর্যন্ত। আদানি পেয়েছে ৫ দশমিক ৪০২৭ টাকা। আদানিকে কয়লার সিস্টেম লস দেয়া হয়েছে ১ দশমিক ১০ শতাংশ, বর্তমান দামে এর অর্থমূল্য বছরে ১ হাজার কোটির বেশি।

ঝাড়খন্ডের গোড্ডার আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্রটির স্থাপিত ক্ষমতা বা প্রকৃত ক্ষমতা হলো ১৪৯৮ মেগাওয়াট। এই ১৪৯৮ মেগাওয়াটের মধ্যে সারা বছর ৩৪ শতাংশ বিদ্যুৎ বাংলাদেশকে নিতেই হবে। যদি এর কমে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ নেয়, তাহলে ৩৪ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে যত কয়লা ব্যবহার করা হতো তার পুরোটার দাম বাংলাদেশ আদানিকে দেবে। শুধু কয়লার দামই নয়, কয়লা পরিবহনের জাহাজ ভাড়া, বন্দরের ব্যয় ও কয়লা পরিবহনের অর্থ পাবে আদানি। অথচ বাংলাদেশে কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ নেয়ার বাধ্যবাধকতা নেই, সে কারণেই কেন্দ্রগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয়।

২০১৬ সালে গোড়ার দিকে আদানি গ্রুপ ভারত থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানির আগ্রহ দেখিয়ে প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবে বলা হয়, ভারতের ঝাড়খন্ডে আদানির কয়লাখনি রয়েছে। সেই খনির কয়লা দিয়ে ভারতের ঝাড়খন্ডের গোড্ডায় তারা ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করবে।

More From Author

একজন আদর্শবান মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আঃ ওহাব হাওলাদার

মেট্রোর মিরপুর-১০ স্টেশন চালু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *