বিশুদ্ধ পানিসংকটে পড়তে যাচ্ছে দেশ

‘জলবায়ু’ শব্দটি ব্যাপক পরিচিত হলেও অনেকেই শব্দটির মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পারেননি। বিষয়টি বোঝেন সবাই; কিন্তু বোঝাতে সক্ষম নন। জলবায়ুর ক্ষেত্রে একটি ছোট্ট হিসাব-নিকাশ আছে। হিসাবটি জানানোর আগে আমরা জেনে নিই জলবায়ুর উপাদানগুলো। যেমন- বায়ু, বায়ুচাপ, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, মেঘ-বৃষ্টি, তুষারপাত, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যৎপাত ইত্যাদি জলবায়ুর উপাদান। আর ছোট্ট হিসাবটি হচ্ছে, কোনো নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলের ২৫-৩০ (মতান্তরে ১০-১২) বছরের গড় আবহাওয়াই হচ্ছে জলবায়ু। অর্থাৎ দীর্ঘমেয়াদি আবহাওয়ার পরিবর্তনটিই হচ্ছে মূলত জলবায়ু পরিবর্তন।

জলবায়ু পরিবর্তনকে আমরা সাধারণত ‘জলবায়ু সংকট’ বলে থাকি। এ ছাড়া আবহাওয়ার মতো জলবায়ুর উপাদানগুলো নিয়ন্ত্রিত হয় অক্ষাংশ, ভূপৃষ্ঠের উচ্চতা, বনভূমি, ভূমির ঢাল, পর্বতের অবস্থান, সমুদ্র থেকে দূরত্ব, সমুদ্রস্রোত, বায়ুপ্রবাহের দিক, মাটির বিশেষত্ব ইত্যাদির মাধ্যমে। এই নিয়েই জলবায়ু সংকট তৈরি হয়। যার ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে; বৈজ্ঞানিক ভাষায় যাকে ‘গ্রিনহাউস’ প্রতিক্রিয়া বলা হয়। সর্বসাধারণের কাছে সেটি বৈশ্বিক উষ্ণতা নামেও পরিচিত।

জলবায়ুর প্রভাবের সঙ্গে আমাদের বেঁচে থাকার সম্পর্কটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে ২০১৯ সালের বৈশ্বিক উষ্ণায়ন। অন্যান্য বছরের তুলনায় সেই বছরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি বিশ্ববাসীকে ভাবিয়ে তুলেছিল। উপমহাদেশীয় অঞ্চলেও ব্যাপক তাপমাত্রা বিরাজ করছিল ২০১৯ সালে। শুধু তাই-ই নয়, ভারতের শতাধিক লোকের মৃত্যুর খবরও আমরা জানতে পেরেছি একই বছর। এসব হচ্ছে শুধু জলবায়ু সংকটের প্রভাবে। উল্লেখ্য, বন্যা, খরা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি জলবায়ুর প্রভাবেই ঘটছে। নদীভাঙনের বিষয়টিও জলবায়ু সংকটের সঙ্গে সম্পৃক্ত। জলবায়ু সংকটের কারণে বঙ্গোপসাগরের ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে যেমন, তেমনি সেসব ঘূর্ণিঝড় খুব শক্তিশালী হয়ে উপকূলে আঘাতও হানছে। আমরা ইতিপূর্বে সুপার সাইক্লোন-৯১, সিডর, আইলা, মোরা, বুলবুল, আম্ফান ও ইয়াস ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবলীলা দেখেছি। আমরা দেখেছি অসংখ্য মানুষ, গবাদি পশু আর বন্যপ্রাণীর মরদেহ যত্রতত্র পড়ে থাকতে। সেই সঙ্গে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির বিষয় তো আছেই। এ ছাড়া জলোচ্ছ্বাসের কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের ভূমির লবণাক্ততা বৃদ্ধির বিষয়টি আশঙ্কা জাগিয়েছে আমাদের। যার কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে চাষাবাদে যেমন বিঘ্ন ঘটছে, তেমনি চিংড়ি চাষে ব্যাপক বিপর্যয় নেমে এসেছে। আবার অতিরিক্ত লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য, গাছগাছালি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ ভয়ংকর দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হচ্ছে শুধু একটি কারণেই, আর সেটি হচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন।

বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বা জলবায়ু সংকটের জন্য মূলত দায়ী হচ্ছে শিল্পোন্নত দেশগুলোর স্বেচ্ছাচারিতা। সেই দেশগুলোর স্বেচ্ছাচারিতার খেসারত দিতে হচ্ছে স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে এখন। তারা একদিকে কার্বন নিঃসরণ বাড়িয়ে দিচ্ছে, অন্যদিকে জলবায়ু সংকটের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে অনুদানও দিচ্ছে। অনেকটা গোড়া কেটে পানি ঢালার মতো।

সমীক্ষায় জানা গেছে, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে হিমালয়ের বরফও গলে যাচ্ছে দ্রুততর। ২০০০ সাল পর্যন্ত হিমালয়ের বরফ শতকরা একভাগ হারে গলেছে। বর্তমানে হিমালয়ের বরফ দ্বিগুণ হারে গলছে! তাতে চীন, ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটানসহ এশীয় অঞ্চলের শতকোটি মানুষ বিশুদ্ধ পানি সমস্যায় পড়বে। উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে জার্মানির বন শহরে যখন জলবায়ু সম্মেলন চলছিল, ঠিক তখনই ‘সায়েন্স অ্যাডভান্সেস’-এর রিপোর্টে এসব তথ্য প্রকাশিত হয়েছিল।

অনুমান করা হয়েছে, সারা বিশ্বে মোট মজুত জলের পরিমাণ ১ দশমিক ৩৮৬ বিলিয়ন কিউবিক কিলোমিটার। তার মধ্যে সমুদ্রে সঞ্চিত লবণাক্ত জলের পরিমাণ ৯৭ দশমিক ২ শতাংশ, যা মোটেই পানযোগ্য নয়। অন্যদিকে ২ দশমিক ১৫ শতাংশ পানি জমাটবদ্ধ হয়ে আছে বরফাকারে। সেটিও পানযোগ্য নয়। বাকি শূন্য দশমিক ৬৫ শতাংশ পানি সুপেয় হলেও প্রায় শূন্য দশমিক ৩৫ শতাংশ পানি রয়েছে ভূগর্ভে, যা উত্তোলনের মাধ্যমে আমাদের দৈনন্দিন পানযোগ্য জলের চাহিদা পূরণ করতে হয়। এই পানি আমাদের কাছে বিশুদ্ধ পানি হিসেবে পরিচিত। এই জলের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে প্রত্যেক মানুষের জন্য দৈনিক গড়ে তিন লিটার হারে। ভূগর্ভস্থ পানি ছাড়া নদ-নদী, খাল-বিল কিংবা পুকুর-জলাশয়ের পানি সুপেয় হলেও তা বিশুদ্ধ নয়। তবে সেটিও আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অংশ। বিশেষ করে গোসলাদি, রান্নাবান্না, জামাকাপড় ধোয়ার কাজে এ জলের ব্যাপক প্রয়োজন পড়ে। তাতে একজন মানুষের সব মিলিয়ে গড়ে ৪৫-৫০ লিটার জলের প্রয়োজন হয়।

বাস্তবতা হচ্ছে, বিশ্বের মোট আয়তনের তিন ভাগ জলরাশি হলেও বিশুদ্ধ পানিসংকটে ভুগছে ৮০টি দেশের প্রায় ১১০ কোটি মানুষ। এ ছাড়া প্রতিবছর বিশ্বের প্রায় ১৮ লাখ শিশু প্রাণ হারাচ্ছে শুধু দূষিত পানি পান করে। বিশুদ্ধ জলের অভাবের নানা কারণও রয়েছে। এর মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, খরা, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়া এবং আর্সেনিকের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। জানা যায়, বৈশ্বিক উষ্ণতা আর মাত্র ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লেই বিশ্বের ১৪৫ কোটি মানুষ সুপেয় পানিসংকটের মুখোমুখি হবে। তার মধ্যে এশিয়া মহাদেশে ১২০ কোটি এবং আফ্রিকা মহাদেশে ২৫ কোটি মানুষ এর আওতায় পড়বে। এ থেকে বাদ যাবে না বাংলাদেশের মানুষও। বরং তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশ বেশি পানিসংকটে পড়বে। এ ছাড়া অন্যান্য মহাদেশের তুলনায় এশীয় অঞ্চলে এর প্রভাব পড়বে খানিকটা বেশি। তার ওপর আমাদের জন্য মহা অশনিসংকেত হচ্ছে, হিমালয়ের বরফ গলার হার দ্বিগুণ বেড়ে যাওয়া। যেখানে ২৫ বছর আগে ৫০ সেন্টিমিটার বরফ গলেছে, সেখানে দ্বিগুণ হারে বরফ গলছে বর্তমানে। হিমবাহ গবেষকদের অভিমত, এই হারে বরফ গলতে থাকলে এশিয়ার কয়েকটি দেশের ১০০ কোটি মানুষ সরাসরি বিশুদ্ধ পানি সমস্যায় ভুগবে। এই দুর্যোগ থেকে উত্তরণের পথও বাতলে দিয়েছেন গবেষকরা। তারা স্পষ্ট বলেছেন, কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নামাতে হবে। তাতে বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধ হবে।

প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, শিল্পোন্নত দেশের বলির পাঁঠা স্বল্পোন্নত দেশগুলো কেন হতে যাবে! বিষয়টি পর্যালোচনার জন্য বিশ্ব বিবেকের কাছে আমাদের আবেদন রইল তাই। আমাদের আরজি ‘কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে এনে আমাদের বাঁচতে দিন; আমরা বাঁচতে চাই।’ সবারই জানার কথা এই গ্রহের মায়ামোহ আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। এখানে আমাদের পিতা-পিতামহ-প্রপিতামহ শুয়ে আছেন। আমরা যেমন কাউকে ছেড়ে গ্রহান্তরিত হতে পারব না, তেমনি আমাদের আগামী প্রজন্মকেও একটি অরক্ষিত গ্রহে রেখে যেতে পারব না। আর মানুষ যদি নাই-ই বাঁচতে পারল, চাঁদ কিংবা মঙ্গল বিজয়ে কী হবে ঠিক বুঝতে পারছি না আমরা! কাজেই বিষয়টি নিয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি আমরা। কারণ এসব নিয়ে ভাবাভাবি কিংবা লেখালেখির সময় এখন আর নেই, সেই সময় ফুরিয়ে গেছে অনেক আগেই।

অনেক লেখালেখি হয়েছে, অনেক সেমিনার, সিম্পোজিয়ামও হয়েছে এসব নিয়ে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তাই যা করার তড়িৎ গতিতেই করতে হবে এখন। কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে এনে মানবসভ্যতার জয়জয়কার ছড়িয়ে দিতে হবে। সুতরাং মুখে মুখে নয়, তা বাস্তবায়ন করে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিতে হবে মোড়ল দেশগুলোকে। তা হলে সার্থক হবে তাদের মোড়লিপনা, অন্যথায় এশিয়ার শতকোটি মানুষকে চরম দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করতে হবে। এই চরম সত্যটিকে উপলব্ধি করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি আমরা। তবে একটি ভালো খবরও আছে, সেটি হচ্ছে, ইতিমধ্যে মরুর দেশ সৌদি আরব জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিশ্বকে রক্ষা করতে যুগান্তকারী দুটি উদ্যোগ হাতে নিয়েছে।

সম্প্রতি সৌদি যুবরাজ ‘সৌদি সবুজায়ন’ ও ‘মধ্যপ্রাচ্যের সবুজায়ন’ নামে দুটি বৃহৎ আকারের কর্মপরিকল্পনার ঘোষণা দিয়েছেন। তার মধ্যে সবুজায়নের লক্ষ্যে ১০ বিলিয়ন গাছ লাগানো ও ১৩০ মিলিয়ন টন কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করার ঘোষণা দিয়েছেন। এ ছাড়া পুরো মধ্যপ্রাচ্য সবুজায়নের লক্ষ্যে ৫০ বিলিয়ন গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করেছেন। সৌদি আরবের এই পরিকল্পনা বিশ্বে দৃষ্টান্ত হতে পারে বলে আমাদের বিশ্বাস। বিশ্বের অন্য উন্নতশীল দেশগুলো যদি এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তবে হয়তো কার্বন নিঃসরণের মাত্রা দ্রুত কমিয়ে আনা সম্ভব হবে; সার্থক হবে তাদের মোড়লিপনাও।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও জলবায়ুবিষয়ক কলামিস্ট

ঢাকায় আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বিকেলে দূতাবাস উদ্বোধন

ইউনিভার্সেল মেডিকেলে ডিজিকেয়ার ডিসেমিনেশন কর্মশালা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *