যুদ্ধের অবসানে চীন এখন মধ্যস্থতায় কেন আগ্রহী

ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান ঘটাতে গত এক বছরে পশ্চিমা দেশগুলো চীনের সাহায্য পাওয়ার চেষ্টা করেছে। রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র চীনের পক্ষ থেকে যুদ্ধ থামাতে বলিষ্ঠভাবে কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। তবে এবার চীন ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানে ১২ দফার একটি শান্তি প্রস্তাব দিয়েছে। চীনের এমন প্রস্তাব ইউক্রেনের পশ্চিমা মিত্রদের খুশি করতে পারেনি।

সাম্প্রতিক দিনগুলোতে চীনা কূটনীতিক ওয়াং ইর ইউরোপ সফরের মধ্য দিয়ে চীন সবার মন জয় করার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, অবশ্য যেটি শেষ হয়েছে মস্কোতে ওয়াং ইয়ের রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের উষ্ণ অভ্যর্থনার মধ্য দিয়ে।

ইউক্রেন প্রশ্নে চীন মূলত একটি নয় বরং দুটি অবস্থানের কথা ঘোষণা করেছে। প্রথমটি, যুদ্ধের অবসানে চীনা সমাধানের প্রস্তাব এবং অন্যটি বিশ্ব শান্তির লক্ষ্যে এক পরিকল্পনার রূপরেখা। এগুলো মূলত চীনা বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি। গত এক বছর ধরে চীনা নেতারা যা বলে আসছেন। এতে রয়েছে (ইউক্রেনের জন্য) সার্বভৌমত্ব রক্ষার আহ্বান এবং (রাশিয়ার) জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থ রক্ষা করে (যুক্তরাষ্ট্রের) একতরফা নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করা। এসব বিষয় পশ্চিমা দেশগুলোকে হয়তো খুশি করবে না, কিন্তু তাদের খুশি করা কখনই চীনের প্রধান লক্ষ্য ছিল না।

চীন কেন এখন ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানে মধ্যস্থতায় আগ্রহী হয়ে উঠেছে- সে প্রসঙ্গে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, চীন প্রথমত, বিশ্বের শান্তিরক্ষক হিসেবে নিজের অবস্থান তৈরি করতে চাইছে। তারা আসলে কাকে দলে টানতে চাইছে সেটার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত তাদের দলিলে রয়েছে, যেখানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকা তথাকথিত গ্লোবাল সাউথের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থার একটি বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করে চীন বিশ্বের বাদবাকি সেসব দেশের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছে যারা এখন নজর রাখছে পশ্চিমা দেশগুলো কীভাবে ইউক্রেনসংকট মোকাবিলা করে তার ওপর।

চীনের আরেকটি লক্ষ্য হলো, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে একটি সুস্পষ্ট বার্তা পাঠানো।

যুক্তরাজ্যের নিউ সাউথ ওয়েলস ইউনিভার্সিটির চীন-রাশিয়ার সম্পর্কের একজন বিশেষজ্ঞ ড. আলেকজান্ডার কোরোলেভ বলছেন, ‘এর মধ্যে বিরুদ্ধাচরণের স্পর্ধা দেখানোর একটি ব্যাপারে রয়েছে। এটি বার্তা দিচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক যদি খারাপ হয়, তা হলে চীন অন্য কারও কাছে যেতে পারে। রাশিয়া একা নয়, যার মানে হলো যখন যুদ্ধ হবে তখন চীনও একা থাকবে না। যুক্তরাষ্ট্র চীনকে ধমকা-ধমকি করে তেমন সুবিধা করতে পারবে না।

যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে সম্পর্ক এখন সবচেয়ে তিক্ত। সম্প্রতি গোয়েন্দা বেলুন কাণ্ডে এই সম্পর্ক আরও খারাপ হয়েছে। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, চীন কেন ঠিক এই সময়টিতে ইউক্রেনের শান্তির জন্য কূটনৈতিক চাপ বাড়িয়েছে। ড. কোরোলেভ বলেন, ‘নেতৃত্ব দেখানোর জন্য যথেষ্ট সুযোগ চীনের ছিল।’ তিনি বলেন ‘লড়াইয়ের অবসান ঘটাতে ভূমিকা রাখার জন্য প্রথম দিকেই চীনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। যদি সত্যি তাদের লক্ষ্য থাকত বিশ্বনেতা হিসেবে ভাবমূর্তি গড়ে তোলা, তা হলে গত একটি বছর দেশটি দর্শকের ভূমিকায় থাকত না।

চীনের তৃতীয় একটি উদ্দেশ্য রয়েছে এবং ওয়াংয়ের ভ্রমণসূচি থেকে এটা বোঝা যায়। ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি এবং হাঙ্গেরি, যে দেশগুলোর নেতারা রাশিয়ার প্রতি কম কট্টরপন্থি বলে চীন বিশ্বাস করে, এসব দেশ সফর করে ওয়াং হয়তো দেখতে চাইছেন যে ইউরোপের কিছু অংশকে চীনা বলয়ের দিকে প্রলুব্ধ করা যায় কিনা।

এ প্রসঙ্গে ইস্ট চায়না নর্মাল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অর্থনীতির বিশেষজ্ঞ ঝ্যাং শিন বলেন, এই দেশগুলোর সঙ্গে বেইজিং ‘স্বার্থের যৌক্তিক মিলন’ দেখতে পাচ্ছে। চীন বিশ্বাস করে যুক্তরাষ্ট্র একটি আধিপত্যবাদী শক্তি এবং তার থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারলে ট্রান্স-আটলান্টিক বিশ্বের একটি বড় অংশ হয়তো উপকৃত হবে। কিন্তু সেই নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে চীন আদৌ সফল হবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্সে চীনা কূটনীতিক ওয়াং যুক্তরাষ্ট্রের কড়া সমালোচনা করেন। এই সমালোচনা সেখানে উপস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের কট্টর মিত্ররা ভালোভাবে গ্রহণ করেনি এবং কূটনীতিকদের মতে, এই ভাষণ শুধু চীনের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবিশ্বাসের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে।

More From Author

রাষ্ট্রপতির বাড়িতে মেহমান হবেন প্রধানমন্ত্রী, খাবেন হাওরের মাছ

অবহেলিত জমিতে সূর্যমুখী চাষে নারীরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *