পুঁজিবাজারে লেনদেন একেবারেই তলানিতে নেমে এসেছে, সূচক পড়ছেই। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের টাকা আটকে গেছে। সবার মধ্যে ক্ষোভ-হতাশা বিরাজ করছে।
বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে মানুষ পুঁজিবাজার থেকে একেবারেই মুখ ফিরিয়ে নেবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি জোর করে পুঁজিবাজার ভালো রাখার যেসব চেষ্টা করেছিল, তার সবগুলোই ব্যর্থ হয়েছে। বিএসইসির প্রধানসহ সংস্থাটির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ছোট-বড় সব বিনিয়োগকারীর অভিযোগের শেষ নেই। তারা বলেছেন, বিএসইসির কর্তাব্যক্তিরা শুধু বড় বড় কথাই বলে গেছেন, কাজের কাজ কিছুই করেননি। সে কারণেই বিনিয়োগকারীরা এখন সব হারিয়ে পথে বসেছেন।
দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) গত বুধবার লেনদেন হয়েছে মাত্র ২৫৭ কোটি। ২০০৭ সালে দেশের পুঁজিবাজারে গড়ে ২০০ কোটি টাকা লেনদেন হতো। লেনদেনের হিসাব করলে বাজার ফিরে গেছে ১৫ বছর আগের অবস্থানে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের পুঁজিবাজারকে নিজের গতিতে চলতে না দিয়ে কৃত্রিমভাবে ভালো রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। সেটা করতে গিয়ে বাজারের কারসাজি চক্রকে কিছুটা ছাড় দেয়া হয়েছে। আবার কোম্পানিগুলোর সুশাসনসহ বাজারের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে এড়িয়ে বেশি মনোযোগ দেয়া হয়েছে পতন ঠেকানোর দিকে। কিন্তু একদিকে অর্থনীতিতে করোনাভাইরাসসহ ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব, অন্যদিকে অব্যবস্থাপনার কারণে পুঁজিবাজারের লেনদেন গিয়ে ঠেকেছে তলানিতে। সব মিলিয়ে দেশের পুঁজিবাজারের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা নেই বললেই চলে।
কারসাজি ঠেকাতে পারেনি কমিশন
অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশনের সমালোচনা করেছেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন। অধ্যাপক ড. এম খায়রুল হোসেনের কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর যে প্রত্যাশা নিয়ে বর্তমান কমিশন গঠন হয়েছিল, তার কোনোটিই বাস্তবায়িত হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বর্তমান কমিশন কোনটা মেইনটেইন করেছে? মার্কেট তো আস্থার জায়গা, একটি জায়গায় বিশ্বাস নিয়ে আসতে পেরেছে? সুশাসন নিয়ে এসেছে? আইনের শাসন বাস্তবায়ন করতে পেরেছে? কাউকে সাজা দিয়েছে?’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল আমিন দৈনিক বাংলাকে বলেন, বিভিন্ন সময়ই দেখা যাচ্ছে অনেক কারসাজি প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট শেয়ার নিয়ে কারসাজি করছে। তাদের কারসাজির কারণে সেসব শেয়ারের দাম বাড়ছে আর অন্য শেয়ারের দাম কমছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীসহ পুরো বাজার।
তিনি বলেন, ‘একটা প্রতিষ্ঠান থেকে যখন একটা শেয়ার নিয়ে কারসাজি করা হয়, তখন সেই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। চাকরি চলে গেলেও কীবা হয়? যে শেয়ারটা ডাম্পিং হয়েছে সেটা তো ওই প্রতিষ্ঠানের ফান্ডকে ব্লক করে দিয়েছে। পাশাপাশি সাধারণ বিনিয়োগকারী যারা এই শেয়ারটা কিনেছিলেন তারাও ব্লক হয়ে গেছেন। এভাবে যদি বিভিন্ন শেয়ার, বিভিন্ন ফান্ড ব্লক হয়ে যায়, সেটা তো আর লিকুইড হয়ে বাজারে আসে না। এতে করে একদিকে যেমন ফান্ড আসছে না, অন্যদিকে গুটিকয়েক শেয়ার নিয়েই কারসাজি চলছে। কিছু শেয়ার অতিমূল্যায়িত হচ্ছে। তার পরও তেমন কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না। এতে ৩৫ টাকার শেয়ার হয়ে যায় ৩০০ টাকা, ৮০ টাকার শেয়ার হয়ে যাচ্ছে ১ হাজার টাকা। সবকিছু মিলিয়ে বাজারের যে তারল্যটা থাকার কথা, তা থাকে না। তাই বাজারের এই নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
কোম্পানির সুশাসন, কোম্পানিগুলোর হিসাবব্যবস্থা ঠিক হয়নি
করপোরেট গভর্ন্যান্স বাস্তবায়নের কথা বললেও তার প্রতিফলন দেখা যায়নি বলে অভিযোগ করেন মিনহাজ মান্নান ইমন। তিনি বলেন, ‘আইপিওর কোনো পরিবর্তন হয়েছে? ব্যালান্সশিটে পরিবর্তন হয়েছে? কোম্পানির মালিকদের চরিত্র সংশোধন হয়েছে? অপরাধের সাজা হয়েছে? মিনিংফুল সাজা হতে হবে। একটা কোম্পানির ইপিএস এক কোয়ার্টারে এক রকম, আরেক কোয়ার্টারে মাইনাস। সেগুলো কি ঠিক করতে পেরেছেন? ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জকে কোনো জায়গায় আনতে পেরেছেন?’
সুশাসন প্রতিষ্ঠার আশা দিয়েও রাখতে পারেননি
শিবলী কমিশন আশার বুলিতে কিছু সময়ের জন্য বাজার চাঙা হলেও পরবর্তী সময়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে। যার কারণ উল্লেখ করে ডিএসইর মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, ‘বর্তমান কমিশনের অধীনে যে কারণে বাজার বেড়েছিল, সেগুলো কী কী ছিল? কতগুলো আশার বেলুন তৈরি করেছিলেন। সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করবেন। সেগুলো হয়নি।’
বিদেশি বিনিয়োগ আসবে বলেছিলেন, আসেনি
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন আরও বলেন, ‘তারা কীভাবে বললেন যে ২২ হাজার কোটি টাকা বিদেশি বিনিয়োগ আসবে। কোথায় সেটা? দেখান সেটা। স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড পৃথিবীর কোথায় আছে? ডিভিডেন্ড পে করিনি, সেই টাকাটা নিয়ে যাবেন। সেটা কোথায় দেবেন? এভাবে চলতে থাকলে বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজারবিমুখ হবেন।
ব্রোকারেজ হাউস ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন সার্ভিসেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাক আহমেদ সাদিক বলেন, ‘সাধারণ বিনিয়োগকারীদের দেশের পুঁজিবাজারের ওপরে কোনো আত্মবিশ্বাস নেই। অনেক দিন ধরে ফ্লোর প্রাইসে শেয়ারটা পড়ে আছে। মানুষ বিক্রি করতে পারছে না, কিনতেও পারছে না। যা কিছু লেনদেন হচ্ছে সেটা হচ্ছে ব্লক মার্কেটে। এভাবে যদি চলতে থাকে, তাহলে সাধারণ মানুষ আর পুঁজিবাজারের নামই নেবে না।’
ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ফিন্যান্সের অধ্যাপক মোহাম্মদ মুসা দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘মানুষজন বিপদে পড়ে গেছে। পুঁজিবাজার আছে কিন্তু মানুষ শেয়ার বিক্রি করতে পারছে না।’
সূচকের পতন ঠেকানোর প্রচেষ্টা কাজ করেনি
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ঠেকা দিয়ে সূচকের পতন ঠেকানোর প্রচেষ্টা রয়েছে বর্তমান কমিশনের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ‘কমিশন যদি ভালো কিছু না-ও করতে পারে, তাহলে মার্কেটে ইন্টারফেয়ার করে কেন? তারা কেন ফ্লোর প্রাইস দিয়েছে? সূচক পড়ে গেলে তার জন্য কমিশন দায়ী নয়, সেটা ডিমান্ড-সাপ্লাইয়ের ব্যাপার। সূচকের পড়তির ব্যাপারে কমিশনের এত দুশ্চিন্তা কেন? এখন তো বাজার অচল।’
খারাপ অর্থনীতির পাশাপাশি এখন বড় সমস্যা ফ্লোর প্রাইস
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক শাব্বির আহমদ দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘বড় একটি প্রভাব পড়েছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে। ইউরোপ থেকে আমেরিকা সব জায়গায় মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়ে গেছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে এসেছে। মানুষ বিনিয়োগ না করে টাকা নিজের কাছে রেখে দিচ্ছে।’
আইডিএলসি সিকিউরিটিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাইফুদ্দীন দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘বাজারের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে এখনকার ফ্লোর প্রাইস। এমনিতে তো একটি অর্থনৈতিক সমস্যা আছেই, সেটা তো সারা বিশ্বেই আছে। অন্যান্য দেশে যেটা হয়েছে বাজার কমে গেছে। বায়ার চলে এসেছে। আমাদের দেশে অর্থনৈতিক সমস্যার রিফ্লেকশন বাজারে ঠিকমতো আসেনি। বাজার মনে করছে শেয়ারের দাম আরেকটু কমবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ তুলে নিচ্ছেন। তারা মনে করছেন, সামনে ডলারের দাম আরও বাড়বে। পাশাপাশি ফ্লোর প্রাইস থাকায় তারা বাজার থেকে সরে যাচ্ছেন।’
ফ্লোর প্রাইস তুলে দেয়ার পরামর্শ
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ‘এটা তুলে দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে। টার্নওভার বেড়ে যাবে। অনেক লোক লোকসান দিয়েও শেয়ার বেচতে রাজি আছে। অনেক কোম্পানির আয় খারাপ হয়েছে, সেগুলোর দর নিচে যাবে না? কিন্তু ফ্লোর প্রাইসের জন্য আটকে আছে। কেনার লোক নেই। ভালো যদি না-ই করতে পারে, তাহলে বাজারকে নিজস্ব ধারায় চলতে দেয় না কেন? তাহলে আর কেউ অভিযোগ করত না।’
বিএসইসি চেয়ারম্যানের বক্তব্য
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘এই সপ্তাহটা যাক, আগামী সপ্তাহ থেকে আমরা ব্যবস্থা নেব। আমরা বিষয়গুলো নজর রাখছি। এখন ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে দিলে অনেক ফোর্সড সেল হয়ে যাবে। ফোর্সড সেলটা কোনোভাবে বন্ধ করার বুদ্ধি যদি পেতাম তাহলে ভালো হতো। চিন্তাভাবনা করছি এই সপ্তাহটা সময় দিই। আসলে আমরা তো সব দেখতে পারব না। আমরা হয়তো পিই রেশিও দেখতে পারি। ডিভিডেন্ড পেআউট রেশিও দেখতে পারি। কিন্তু লেনদেন নিয়ন্ত্রণ কীভাবে করতে পারব। সবাই আমাদের দিকে আঙুল তোলে।’