কর্মকর্তা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির ১৯টি শর্তের অন্যতম ছিল ‘প্রার্থীদের চূড়ান্ত নিয়োগ লাভের পূর্বে স্বাস্থ্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে।’ কিন্তু যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড নিজেদের দেয়া সে শর্তই মানেনি। সম্প্রতি স্বাস্থ্য পরীক্ষা ছাড়াই ১৭ কর্মকর্তাকে নিয়োগপত্র দেয়া হয়েছে।
শুধু তা-ই নয়, ওই ১৭ কর্মকর্তা নিয়োগে আরও কিছু অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) অধীন এই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। বিশেষ করে কনফিডেনশিয়াল অফিসার পদে পাঁচ কর্মকর্তা নিয়োগ নিয়ে বেশি প্রশ্ন উঠেছে। বাদ পড়া নিয়োগপ্রার্থীদের অভিযোগ, যেভাবে নিয়োগপত্র দেয়া হয়েছে, তা অসচ্ছ। মূলত পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ দিতেই এমন অনিয়ম করা হয়েছে।
ভুক্তভোগী এক প্রার্থী তথ্য অধিকার আইনে পূর্ণাঙ্গ নম্বরপত্রসহ মেধাতালিকা প্রকাশ ও তাকে মেধাতালিকায় যোগ্য বিবেচনা না করার যৌক্তিক কারণ চেয়ে যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডকে চিঠি দিলেও সাড়া পাননি। নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়া আরও দুজন প্রার্থী বলেছেন, তারাও কোনো উত্তর পাননি। উল্টো তাদের বর্তমান প্রতিষ্ঠানে চিঠি দিয়ে হয়রানি করার হুমকি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে যমুনা অয়েলের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।
নিয়োগ প্রক্রিয়া
গত বছরের ৮ মার্চ ১১ পদে ১৭ জন কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য চারটি দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড। এর মধ্যে কনফিডেনশিয়াল অফিসার পদে ছিল পাঁচটি শূন্যপদ। বাকি ১০টি পদের মধ্যে সিনিয়র অফিসার (অ্যাকাউন্টস) ও জুনিয়র অফিসার (অ্যাকাউন্টস/ফাইন্যান্স) পদে দুজন করে ছিল।
অন্য আট পদ সিনিয়র অফিসার (মেইনটেন্যান্স), সিনিয়র অফিসার (অপারেশন), অফিসার (হিউম্যান রিসার্চ), অফিসার (টেকনিক্যাল সার্ভিসেস), জুনিয়র অফিসার (সেলস), জুনিয়র অফিসার (পার্চেজ), জুনিয়র অফিসার (প্ল্যানিং অ্যান্ড ইকোনমিকস) ও জুনিয়র অফিসার (ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট)।
বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের প্রায় সাড়ে চার মাস পর গত ২৯ জুলাই সব পদের প্রার্থীর একযোগে লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ২ অক্টোবর ১১টি পদের মধ্যে আট পদে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করা হয়। গত ১৪ অক্টোবর থেকে ১৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদে যমুনা ভবনে মৌখিক পরীক্ষা হয়। আট পদের বিপরীতে ১৫০ জন মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেন। এর মধ্যে পাঁচ পদের বিপরীতে কনফিডেনশিয়াল পদে মৌখিক পরীক্ষা দেন ৫৫ জন। মৌখিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার সাড়ে তিন মাস পর গত ৩১ জানুয়ারি ২ মার্চের মধ্যে যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের প্রধান কার্যালয়ে যোগদানের জন্য ১৭ কর্মকর্তার নামে নিয়োগপত্র দেয়া হয়।
নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগ
বিপিসির অধীনে অন্যান্য প্রতিষ্ঠান তো বটেই, যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড নিজেও অতীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাতালিকা প্রকাশ করত। কিন্তু এবার মেধাতালিকা প্রকাশ ছাড়াই সরাসরি নিয়োগপত্র দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি নিয়োগপত্র দেয়া-সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিটি প্রকাশ করা হয় ৩১ জানুয়ারি। তবে সেই বিজ্ঞপ্তিতে যমুনা অয়েলের মানবসম্পদ বিভাগের (এইচআর) উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) সৈয়দ শাহীদুল ইসলামের স্বাক্ষরের নিচে তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ৬ ফেব্রুয়ারি।
কর্মকর্তা নিয়োগের বিজ্ঞপ্তিতে বিপিসির অধীনে থাকা অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো প্রার্থীর নামের পাশাপাশি রোল নম্বরও প্রকাশ করে। কিন্তু যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড রোল নম্বর প্রকাশ করেনি।
এদিকে কনফিডেনশিয়াল অফিসার পদে শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করার বিষয়টি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এটি সপ্তম গ্রেডের। অষ্টম গ্রেডের জুনিয়র অফিসার পদে যেখানে স্নাতকসহ (সম্মান) অন্যান্য ডিগ্রিধারীদের আবেদন করতে বলা হয়েছে, সেখানে সপ্তম গ্রেডের এই পদে স্নাতক চাওয়া হয়নি। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, পছন্দের প্রার্থীদের নিতে শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করা হয়েছে।
দৈনিক বাংলার পক্ষ থেকে যমুনা অয়েলের কনফিডেনশিয়াল পদে নিয়োগ পাওয়া পাঁচ কর্মকর্তার শিক্ষাগত যোগ্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়া একজন প্রার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘আমার লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা খুব ভালো হয়েছে। যে অভিজ্ঞতার কথা বলা হয়েছিল, তাও আমার আছে বলে মনে করি। সে জন্য খুবই আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। কিন্তু আমাকে নির্বাচিত করা হয়নি। আমি কোন প্রক্রিয়ায় বাদ পড়েছি, তা জানতে চিঠি দিয়ে কোনো উত্তর পাইনি। পরে এক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, অভিজ্ঞতা না মেলায় বাদ দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেটিই যদি হয়, তাহলে আমাকে কেন লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার জন্য বিবেচনা করা হলো? মূলত পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ দিতে নিয়োগের প্রতিটি ধাপে অনিয়ম করা হয়েছে।’
এই নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে যমুনা অয়েলের কর্মকর্তাদের মধ্যেও অসন্তোষ আছে। একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ‘১৭ জন কর্মকর্তা নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতেই কোম্পানির বহু টাকা নয়ছয় করা হয়েছে।’
তবে নিয়োগ স্বচ্ছভাবেই হয়েছে বলে দাবি করেছেন যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের উপ-মহাবব্যবস্থাপক (এইচআর) সৈয়দ শাহীদুল ইসলাম। তিনি দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই।’