যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানিতে হোঁচট

টানা তিন মাস ৫ বিলিয়ন (৫০০ কোটি) ডলারের বেশি রপ্তানি আয় দেশে এলেও যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানিতে হোঁচট খেয়েছে। একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশে রপ্তানি বাণিজ্যের সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) এই দেশটিতে ৫৭২ কোটি ৯ লাখ (৫.৭২ বিলিয়ন) ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২ দশমিক ৩ শতাংশ কম।

অথচ ২০২১-২২ অর্থবছরের এই সাত মাসে আগের অর্থবছরের (২০২০-২১) একই সময়ের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৪৭ শতাংশ বেশি রপ্তানি আয় দেশে এসেছিল। এক বছরের রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় দেশটির মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। সে কারণে তারা অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া অন্য পণ্য কম কিনছেন। সে কারণেই আমেরিকায় বাংলাদেশের রপ্তানি কমে গেছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও রপ্তানিকারকরা।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) গতকাল রোববার দেশভিত্তিক পণ্য রপ্তানির হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে বিভিন্ন দেশে পণ্য রপ্তানি থেকে মোট ৩ হাজার ২৪৪ কোটি ৭৫ লাখ (৩২.৪৫ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ বেশি। কিন্তু প্রধান বাজার আমেরিকা থেকে আয় কমেছে।

ইপিবির তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, বরাবরের মতো বাংলাদেশি পণ্যের আমদানিকারক দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষে অবস্থান করছে। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ের যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে ৫ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা এই সাত মাসে মোট রপ্তানির ১৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ। এই সময়ে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ৩ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ওভেন পোশাক রপ্তানি হয়েছে। নিট পোশাক রপ্তানি হয়েছে ১ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারের। অন্যান্য পণ্যের মধ্যে হোম টেক্সটাইল থেকে ৯ কোটি ৮৯ লাখ ডলার, ক্যাপ বা টুপি থেকে ২০ কোটি ৭৭ লাখ ডলার এবং ক্রাস্টেসিয়ানস থেকে ১ কোটি ৫৬ লাখ ৭০ হাজার ডলার এসেছে। জুলাই-জানুয়ারি সময়ে দেশটি থেকে মোট রপ্তানির ২৮ শতাংশ এসেছে ওভেন পোশাক থেকে। নিট পোশাক থেকে এসেছে ১০ শতাংশ। আর প্রায় ১৩ শতাংশ এসেছে হোম টেক্সটাইল থেকে।

গত ২০২১-২০২২ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে ৫ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল, যা ছিল মোট রপ্তানির ১৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। ওই সাত মাসে ওভেন পোশাক থেকে ৩ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার, নিট পোশাক থেকে ১ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার, হোম টেক্সটাইল থেকে ১৭ কোটি ৭৩ লাখ ডলার, ক্যাপ থেকে ১৫ কোটি ডলার এবং ক্রাস্টেসিয়ানস রপ্তানি থেকে ২ কোটি ৯৭ লাখ ডলার আয় হয়েছে।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে আমেরিকায় পণ্য রপ্তানি থেকে আয় আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৭ শতাংশ বেড়েছিল। ২০২০-২১ অর্থবছরের এই সাত মাসে যুক্তরাষ্ট্রে ৩ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছিল।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি বাজার ইউরোপ ও আমেরিকায় উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে গত কয়েক মাস ধরেই দেশে ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ার কথা বলে আসছিলেন তৈরি পোশাকশিল্প মালিকরা। এর সঙ্গে দেশে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট যুক্ত হওয়ায় রপ্তানি খাতের দুরবস্থার কথা বলে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক দিকে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন তারা। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। সবাইকে অবাক করে দিয়ে বেড়েই চলেছে বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস রপ্তানি আয়। নভেম্বর, ডিসেম্বর এবং জানুয়ারি- টানা তিন মাস ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি আয় দেশে এসেছে। এই তিন মাসের আগে কখনোই এক মাসে ৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় দেশে আসেনি।

কিন্তু সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি কমে যাওয়ায় চিন্তার ভাঁজ পড়েছে রপ্তানিকারকদের কপালে। তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘প্রচলিত বাজারের পাশাপাশি অপ্রচলিত (নতুন) বাজারে আমাদের রপ্তানি বেড়েছে। সে কারণে সাত মাসের হিসাবে রপ্তানিতে ১০ শতাংশের মত প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবে কারখানাগুলোতে এই মুহূর্তে পরিপূর্ণ অর্ডার নেই। একটা চ্যালেঞ্জিং সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা। আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বে ব্যাংকের সুদহার বেড়ে যাচ্ছে, মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে বাজারে পোশাকের চাহিদা কমে যাচ্ছে। সে কারণেই যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।’

আমেরিকায় কমলেও সার্বিক রপ্তানি আয় কেন বাড়ছে- এ প্রশ্নের উত্তরে ফারুক বলেন, ‘আমাদের ভাগ্য ভালো যে, আমরা কিছু উচ্চমূল্যের পোশাকের বাজার ধরতে পেরেছি। বিশ্বে এখন আমাদের ইমেজ আগের চেয়ে বেড়েছে। আগে যেখানে ১০ ডলারের বেশি দামের শার্টের অর্ডার দেশে আসত না, এখন সেখানে ২৫-৩০ ডলারের শার্টের অর্ডারও আমরা পাচ্ছি। ১৫ ডলারের জ্যাকেটের পাশাপাশি এখন ২৫-৩০, এমনকি ৩৫-৪০ ডলারের জ্যাকেটের অর্ডারও আসছে। ভারত, কোরিয়া, জাপানের মতো অপ্রচলিত বাজারে আমাদের পণ্য রপ্তানি বেড়েছে। এসব কারণেই খারাপ পরিস্থিতির মধ্যেও রপ্তানি আয় বাড়ছে।’

অর্থনীতির গবেষক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘এটা খুবই ভালো খবর যে, এই কঠিন সময়ে পরপর তিন মাস ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি আয় দেশে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে চীনের অনেক রপ্তানি আদেশ বাংলাদেশে আসছে। ভিয়েতনাম থেকেও কিছু অর্ডার আসছে। এই ভালো অবস্থার মধ্যে যদি যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের রপ্তানি কমে যায় তাহলে কিন্তু চিন্তার বিষয়। আমেরিকায় রপ্তানি কমলে অন্যান্য দেশেও তার প্রভাব পড়বে। তখন কিন্তু আমাদের রিজার্ভের ওপর চাপ আরও বাড়বে।’

জার্মানি বেড়েছে মাত্র ১ শতাংশ
বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম আমদানিকারক দেশ হচ্ছে জার্মানি। চলতি অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে দেশটিতে ৪ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা মোট রপ্তানি আয়ের ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের জার্মানিতে পণ্য রপ্তানি থেকে ৪ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছিল। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, জুলাই-জানুয়ারি সময়ে দেশটিতে রপ্তানি আয় বেড়েছে মাত্র ১ দশমিক শূন্য পাঁচ শতাংশ।

যুক্তরাজ্যে বেড়েছে ১২ শতাংশ
তবে যুক্তরাজ্যে রপ্তানি বেড়েছে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে দেশটিতে পণ্য রপ্তানি থেকে ৩ দশমিক শূন্য ৯ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে এই অঙ্ক ছিল ২ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের তৃতীয় বৃহত্তম আমদানিকারক দেশ হচ্ছে যুক্তরাজ্য।

ফ্রান্সে বেড়েছে ২৭.৬ শতাংশ
জুলাই-জানুয়ারি সময়ে ফ্রান্সে পণ্য রপ্তানি থেকে ১ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি মুদ্রা দেশে এনেছেন রপ্তানিকারকরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে চেয়ে ২৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরের এই সাত মাসে ১ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছিল।

এ ছাড়া জুলাই-জানুয়ারি সময়ে স্পেনে পণ্য রপ্তানি থেকে ১৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ, ইতালিতে ৫৫ দশমিক শূন্য চার শতাংশ, কানাড়ায় ১৬ দশমিক ৫৭ শতাংশ, বেলজিয়ামে ৫ দশমিক ১৮ শতাংশ, নেদারল্যান্ডসে ২২ দশমিক ৮৬ শতাংশ, জাপানে ৪২ দশমিক ৩২ শতাংশ এবং পাশের দেশ ভারতে পণ্য রপ্তানি থেকে আয় ১১ শতাংশ বেড়েছে।

তবে এই সাত মাসে চীন থেকে রপ্তানি আয় কমেছে ১৩ শতাংশ। পোল্যান্ড থেকে ১৫ শতাংশ এবং রাশিয়া থেকে ৪৬ শতাংশ কমেছে।

More From Author

রেখাকার বাবুর আয় সরল রেখায় নয়

মাসে ১২ ডলার গুনতে হবে ফেসবুক ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্টের জন্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *