জয়পুরহাটের জেলাজুড়ে গত এক বছরে (২০২২ সালে) ৫ হাজার ২৬০টি বিবাহ নিবন্ধিত হয়েছিল। বিপরীতে ৩ হাজার ৭৩৬টি (৭১ শতাংশ) বিবাহ বিচ্ছেদের (তালাক) ঘটনাও ঘটেছে। এ ক্ষেত্রে স্ত্রীর পক্ষ থেকে তালাকের প্রবণতা পুরুষের চেয়ে দ্বিগুণ বেড়েছে।
এর আগের বছরগুলোতে স্বামী-স্ত্রী উভয় পক্ষ থেকে তালাকের সংখ্যা প্রায় কাছাকাছি ছিল। গত বছর একাধিক কারণে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে। তবে মুঠোফোনে নারী-পুরুষ উভয়ের পরকীয়ার কারণে বেশির ভাগ বিচ্ছেদ হয়েছে বলে নিকাহ রেজিস্ট্রাররা জানিয়েছেন।
জেলা রেজিস্ট্রার বলেছেন, বিবাহ বিচ্ছেদের মূল কারণই হচ্ছে যৌতুক। বিয়ের পর বর চুক্তি মোতাবেক যৌতুক পাচ্ছেন না। এরপরই বিবাহ বিচ্ছেদ শুরু হয়। এ ছাড়া কারণ হিসেবে মাদকাসক্ত, বাল্যবিবাহ, দীর্ঘদিন স্বামী প্রবাসে থাকা, শ্বশুর-শাশুড়ির নির্যাতনসহ নানা বিষয় উঠে এসেছে।
জয়পুরহাট জেলা রেজিস্ট্রারের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, মোট বিচ্ছেদের মধ্যে স্বামীর পক্ষ থেকে তালাক হয়েছে ৭৭৩টি, স্বামী-স্ত্রী উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে তালাকের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৪৯২টি আর স্ত্রীর পক্ষ থেকে তালাকের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৪৭১টি।
জয়পুরহাট জেলা সহকারী রেজিস্ট্রার আব্দুল খালেক বলেন, ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১ সাল পর্যন্ত বিচ্ছেদ ৪৫ থেকে ৫১ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু গত ১ বছরের বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে।
বিয়ের রেজিস্ট্রি ও তালাক উভয় ক্ষেত্রেই কাজির প্রয়োজন হয়। জয়পুরহাট জেলার ৫টি পৌরসভা এবং ৩২টি ইউনিয়নে মোট কাজি আছেন ৩৭ জন। এই কাজিদের মধ্যে ১২ জনের সঙ্গে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের।
জয়পুরহাট সদর উপজেলার ধলাহার ইউনিয়নের নিকাহ রেজিস্ট্রার (কাজি) মতিউর রহমান বলেন, নানা কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ হচ্ছে। তবে পাঁচ-সাত বছর আগে এক বছরে বিবাহের বিপরীতে এত তালাক হয়নি। বর্তমানে বিবাহ এবং তালাকের সংখ্যা প্রায় কাছাকাছি।
মতিউর রহমান কয়েকটি তালাকের উদাহরণ টেনে বলেন, ছেলেমেয়ের উভয়ের পরিবার নিজেদের দেখাদেখির পর বিয়ে হয়। বিবাহের পর স্ত্রী মুঠোফোনে অন্য ছেলের সঙ্গে পরকীয়া জড়ায়। একপর্যায়ে স্ত্রীর পরকীয়ার কথা স্বামী জানতে পারেন। এ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহ শুরু হয়। বিয়ের গন্ধ শেষ হতে না হতেই উভয়ের সমঝোতায় বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। একইভাবে স্ত্রী তার স্বামীর পরকীয়ার কথা জানতে পারেন। শুরু হয় স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর দ্বন্দ্ব। শেষমেষ তালাক পর্যন্ত চলে যায়।
মতিউর রহমান আরও বলেন, বিবাহের আগে যৌতুক চুক্তি হয়। বিবাহের পর চুক্তি অনুযায়ী যৌতুক মেলে না। এ নিয়ে বর ও বরপক্ষের লোকজন নিজেরাই বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। এরপর তালাকের মাধ্যমে সমাধান টানা হয়।
কালাই উপজেলার পুনট ইউনিয়নের নিকাহ রেজিস্ট্রার আজিজার রহমান (কাজি) বলেন, তার ইউনিয়নে ২০২১ সালে মোট বিয়ে হয় ১৬৭টি। এর মধ্যে স্বামীর পক্ষ থেকে তালাক হয়েছে ৭, স্ত্রীর পক্ষ থেকে ৩৯ এবং উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে তালাকের ঘটনা ঘটেছে ৩১টি।
পুনটে ২০২২ সালে মোট বিয়ে হয় ১৫৪টি। এর মধ্যে স্বামীর পক্ষ থেকে ৬টি, স্ত্রীর পক্ষ থেকে ৫৭ এবং স্বামী-স্ত্রী উভয়ের সম্মতিতে তালাকের ঘটনা ঘটে ৩৯টি।
কালাই উপজেলার আহম্মেদাবাদ ইউনিয়নের নিকাহ রেজিস্ট্রার (কাজি) মুনছুর রহমান বলেন, নিবন্ধন ছাড়াই গোপনে বাল্যবিবাহ হচ্ছে। সেই বিবাহ টিকছে না। আবার স্বামী-স্ত্রীর পরকীয়াসহ নানা কারণও রয়েছে। ছেলেমেয়ের উভয়ের অভিভাবকদের সহনশীল থাকতে হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হচ্ছে। এ কারণে তালাকের সংখ্যা বাড়ছে। আক্কেলপুর পৌরসভার নিকাহ রেজিস্ট্রার (কাজি) নুরন্নবী বলেন, স্বামী-স্ত্রী উভয়ে চাকরি করেন। স্বামী তার চাকরিজীবী স্ত্রীকে যেভাবে চলতে বলেন স্ত্রী তার কথা শোনেন না। এ নিয়ে দাম্পত্যকলহ শুরু হয়। পরে স্বামী-স্ত্রীর তালাক হয়। তবে দাম্পত্যজীবনে সন্দেহ তালাকনামার আরেকটি কারণ।
জয়পুরহাট লাইব্রেরি অ্যান্ড ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রাজা চৌধুরী দৈনিক বাংলাকে বলেন, এতগুলো বিচ্ছেদের প্রধান কারণ সামাজিক অবক্ষয়। বাল্যবিবাহ এবং যান্ত্রিকতার যুগে স্মার্টফোনের ব্যবহার বেশি হওয়ায় ছেলেমেয়েরা পড়াশোনার পরিবর্তে অপ্রাপ্ত বয়সেই প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে আবেগতাড়িত হয়ে বিবাহের পিঁড়িতে বসছে। পরবর্তী সময় এই সংসারগুলো টিকছে না।
জয়পুরহাট জেলা রেজিস্ট্রার (ডিআর) শরীফ তোরাফ হোসেন বলেন, এ জেলায় যৌতুকের প্রথা বেশি। যৌতুকের কারণে বেশির ভাগ বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া আরও কিছু কারণে এ জেলায় বিবাহ বিচ্ছেদের প্রবণতা বেড়েছে।