মৃত্যুকে তার কাছে মনে হতো স্নিগ্ধ-সুন্দর। চলে গেছেন, তাতে কী? মৃত্যু হয়নি তার। এখনো বেঁচে আছেন দর্শক, ভক্ত আর শুভানুধ্যায়ীদের হৃদয়ে। সুতরাং মৃত্যু তার কাছে স্নিগ্ধ রূপেই ধরা দেবে। হুমায়ুন ফরীদি মৃত্যুকে অনিবার্য মেনে নিয়েছিলেন। অনিবার্যকে ভালোবাসাই শ্রেয়। তাকে বরণ করে নিতে হয়। এ তার-ই কথা। তাই আজকের এই দিনে ২০১২ সালে মৃত্যুকে গ্রহণ করেছিলেন এই প্রখ্যাত অভিনেতা।
মঞ্চ, টেলিভিশন কিংবা সিনেমা-অভিনয়ের উদাহরণ চলে এলে একটা নামই সবার আগে চলে আসে- হুমায়ুন ফরীদি। অথচ তিনি হতে চেয়েছিলেন ব্যবসায়ী। ব্যবসাপাতি করে দুটো রোজগার করবেন। কিন্তু পয়সাপাতি খুইয়ে খালি হাতে বাড়ি ফিরেছিলেন। আরও নানা কিছু হতে চেয়েছিলেন, সিনেমা হলের দারোয়ান, বাবুর্চি, চাকরি ইত্যাদি। কিন্তু যিনি এসব কিছুই হবেন পর্দায়, তাকে কি আর বাঁধাধরা কাজ করা চলে? শেষমেশ অভিনেতা হিসেবেই তিনি আমাদের কাছে হয়ে রইলেন চির ভাস্বর।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে দেশ যখন উত্তাল, তখনই পৃথিবীতে আলোর মুখ দেখেছিলেন হুমায়ুন ফরীদি। ২৯ মে ঢাকার নারিন্দায় জন্ম নেয়া ফরীদির অভিনয় জীবনের শুরু ছাত্রজীবনে। মঞ্চে কাজ করতেন তিনি। টিভি নাটকে প্রথম অভিনয় করেন আতিকুল হক চৌধুরীর প্রযোজনায় ‘নিখোঁজ সংবাদ’-এ। জন্মের পর থেকেই ছিলেন ডানপিটে স্বভাবের। মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র তিন মাধ্যমেই সমানতালে কাটিয়ে গেছেন তিন দশক। অভিনয় দিয়ে আমৃত্যু ছড়িয়েছেন আলো। আর ব্যক্তিজীবনটা ছিল সাদামাটা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র অবস্থায় নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন তাকে থিয়েটারে যোগ দেয়ার পরামর্শ দেন। দেশের অন্যতম নাট্যসংগঠন ঢাকা থিয়েটারে শুরু হয় হুমায়ুন ফরীদির থিয়েটার চর্চা। মঞ্চে অভিনয় করেন ‘কীত্তনখোলা’, ‘মুনতাসির ফ্যান্টাসি’, ‘কেরামত মঙ্গল’, ‘ধূর্ত উই’ ইত্যাদি নাটকে। ‘কেরামত মঙ্গল’ নাটকে কেরামত চরিত্রে হুমায়ুন ফরীদির অভিনয় এখনো আলোচিত ঢাকার মঞ্চে।
অভিনয় কীভাবে শুরু করেছিলেন? এ প্রশ্ন করলেই বাবার পকেট থেকে ১০ টাকা চুরির গল্পটা বলতেন। ধরা পড়ার পর বাবা যখন জানতে চাইলেন টাকা নিয়েছেন কি না, তিনি এমন ভাব করতেন, ‘প্রশ্নই ওঠে না’। ওটাই নাকি ছিল তার প্রথম অভিনয়। মঞ্চেই ছিল তার অভিনয়ের মূল পাঠ। কিন্তু মঞ্চ দিয়ে তো আর রোজগার মেলে না। নিজেকে মেলে ধরলেন টিভি ও সিনেমাতে। মূলত খলনায়ক হিসেবেই ধরা দিলেন তুমুলভাবে। শহীদুল ইসলাম খোকন পরিচালিত ‘সন্ত্রাস’ দিয়ে শুরু হয় তার চলচ্চিত্রযাত্রা। খলনায়ক হিসেবে তার মতো এত খ্যাতি আর কাউকে পেতে দেখা যায়নি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘ভিলেনের অভিনয় করা সহজ। যা খুশি তাই করা যায়। কোনো বাধা নেই। নায়ক সেটা পারে না। তাকে ছকে আটকে থাকতে হয়।’
ভাষা আন্দোলনের কালে এক উত্তাল সময়ে জন্ম হয়েছিল হুমায়ুন ফরীদির। ভুবন ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন এই ফাগুনেই। মৃত্যুও তাই তার কাছে এসেছিল ফাগুনের আগুন সৌন্দর্য নিয়ে। শৈশবেই মৃত্যুর এক ধরনের ছবি নিজের মানসপটে এঁকে নিয়েছিলেন ফরীদি। বাবার ছিল বদলির চাকরি। তাই ছোটবেলা কেটেছে নানা শহরে। প্রতিটি শহরের আলাদা গন্ধ নাকে লেগে থাকত তার। বড় হয়ে সেসব শহরে যখন ঘুরেছেন, সেই সব ঘ্রাণ এসে হানা দিত তার কক্ষজুড়ে। শৈশবের নস্টালজিয়া আর স্মৃতিমেদুরতায় একাকার হয়ে তিনি ভাবতেন, মৃত্যু বুঝি প্রচণ্ড রঙিন, অনেক সুন্দর সবুজ, অনেক সুন্দর নীল, অনেক সুন্দর বেগুনি রঙের একটা জায়গা।জীবদ্দশায় সে কথা বলেও গেছেন তিনি, ‘মৃত্যুর মতো এত স্নিগ্ধ, এত গভীর, সুন্দর আর কিছু নেই। কারণ মৃত্যু অনিবার্য। তুমি যখন জন্মেছ, তখন তোমাকে মরতেই হবে। মৃত্যুর বিষয়টি মাথায় থাকলে কেউ পাপ করবে না। যেটা অনিবার্য, তাকে ভালোবাসাটাই শ্রেয়। মৃত্যুকে ভয় পাওয়াটা মূর্খতা। জ্ঞানীরা মৃত্যুকে ভয় পায় না। মৃত্যুকে আলিঙ্গন কর, গ্রহণ কর, বরণ করে নাও।’