চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার বিভীষণ এলাকার কৃষক সাদিকুল ইসলাম। নিজের পাঁচ বিঘা জমিতে ধান আবাদ করেই চলে তার সংসার। গত মৌসুমে তার জমিতে ভালো ফলন হয়েছিল। সব মিলিয়ে ঘরে তুলেছিলেন ১২৫ মণ ধান। তবে এবার আবাদ নিয়েই অনিশ্চয়তা ঘিরে ধরেছে তাকে। পানির অভাবে জমির বুক ফেটে চৌচির। ধান আবাদের সময়ও চলে যাচ্ছে। কিন্তু পল্লী বিদ্যুৎ থেকে গভীর নলকূপের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়ায় জমির বুকে দিতে পারছেন না পানি। শেষ পর্যন্ত সেচের পানি না পেলে হয়তো এবার আবাদই করা হবে না সাদিকুলের। তার চোখেমুখে তাই চিন্তার ভাঁজ। বলছেন, ধানের আবাদ না হলে খাবেনই কী, কীভাবেই বা চলবে সংসার?
শুধু সাদিকুলই নন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার সীমান্তঘেঁষা জনপদ বিভীষণের অধিকাংশ মানুষই কৃষিকাজে যুক্ত। এ বছর বোরো আবাদ করতে গিয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছেন তারা সবাই। কারণ, তাদের সবার জমিতেই সেচের জন্য বসানো গভীর নলকূপের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা পল্লী বিদ্যুৎ। সেচের অভাবে পতিত পড়ে আছে ৪০ কৃষকের ১০০ থেকে ১৫০ বিঘা জমি। এ নিয়ে কৃষকরা জমিতে মানববন্ধনও করেছেন। কৃষকরা বলছেন, আবাদের সময় শেষ হতে চলল। অথচ পল্লী বিদ্যুৎ অফিসে ঘুরেও তারা কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না।
অন্যদিকে পল্লী বিদ্যুতের কর্মকর্তারা বলছেন, সেখানকার জমি একাধিকবার হাতবদল হয়েছে। ফলে সেখানে থাকা গভীর নলকূপের মালিকানা নিয়েও তৈরি হয়েছে জটিলতা। একাধিক পক্ষ নিজের নামে বিদ্যুৎ সংযোগ চায়। এসব জটিলতার কারণেই সেখানকার বিদ্যমান সংযোগটি বিচ্ছন্ন করা হয়েছিল।
বিভীষণ গ্রামের মজিবুর রহমান জানান, নওগাঁ জেলার সাদরুল আমিন চৌধুরী নামে এক ব্যক্তির জমি ছিল ওই এলাকায়। তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে ২০১১ সালে তার জমিতে সেচের জন্য গভীর নলকূপ স্থাপন করেছিলেন। এরপর তিনি তার অধিকাংশ জমিই বিক্রি করে দেন, সেই সঙ্গে গভীর নলকূপটিও এব্রাহিম নামে একজনের কাছে হস্তান্তর করেন।
গভীর নলকূপের চালক এব্রাহিম বলেন, সাদরুল আমিন চৌধুরী জমি বিক্রির পর নলকূপটি আমার কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। তবে বিদ্যুতের মিটার পরিবর্তন করা হয়নি। সাদরুল চৌধুরীর নামেই বিল আসত, ওভাবেই বিল দিয়ে দিতাম। মাসখানেক আগে এক দিন পল্লী বিদ্যুতের লোকজন এসে লাইন কেটে দেন। তখন তারা বলেন, ‘ডিপের (গভীর নলকূল) মালিকানা পরিবর্তন করতে হলে আগে জানাতে হতো। এখন অফিসে যোগাযোগ করিও।’ এরপর অফিসে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। এদিকে পানি ছাড়া ধান লাগাতে পারছেন না কেউ।
ওই এলাকার বাসিন্দা ও গোমস্তাপুর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান হাসানুজ্জামান নূহ বলেন, ‘পল্লী বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দেয়ায় জমিতে সেচ দিতে না পারছেন না বলে ৪০ থেকে ৬০ জন কৃষক আমার কাছে এসেছিলেন। পরে আমি নিজে পল্লী বিদ্যুৎ অফিসে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, বিদ্যুৎ বিল বকেয়া নেই। তবে সংযোগ ও নলকূপের মালিকানা নিয়ে সমস্যা ছিল। আমি তাদের বলেছিলাম, ১০০-১৫০ বিঘা জমির আবাদ বন্ধ হয়ে আছে, লাইনটা চালু করে দেন। কিন্তু লাইন চালু হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক ইঞ্চি মাটিও যেন ফাঁকা পড়ে না থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখতে বলছেন। এমনকি তিনি বাসাবাড়ির ছাদেও ফসল ফলাতে বলছেন। সেখানে শত শত বিঘা জমি পল্লী বিদ্যুতের সিদ্ধান্তহীনতায় সেচের অভাবে পতিত আছে, এটি দুঃখজনক। তারা বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নিতে পারত। কৃষকদের আবাদের সময় পার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কিছুই করেনি।’
কৃষকদের অভিযোগের বিষয়ে পল্লী বিদ্যুৎ নাচোলের সহকারী জেনারেল ম্যানেজার সুভন কুমার মহন্ত বলেন, গভীর নলকূপের মালিকানা পরিবর্তন করতে হলে উপজেলা সেচবিষয়ক কমিটি থেকে অনুমোদন নিতে হয়। বিভীষণ এলাকার গভীর নলকূপটি ব্যক্তিগতভাবে সাদরুল আমিন চৌধুরী বসিয়েছিলেন। তার নামেই বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল। কিন্তু তিনি গভীর নলকূপের মালিকানা পরিবর্তন করেন। বিষয়গুলো সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করে করা হয়নি। ফলে বিদ্যুৎ সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। তবে কৃষকের চলতি বোরো আবাদের কথা ভেবে ওই এলাকার চেয়ারম্যান, কৃষক প্রতিনিধির সঙ্গে বসে বিদ্যুৎ সংযোগটি দেয়ার ব্যবস্থা করব।
কৃষকরা যেন আবাদ করতে পারেন, সে লক্ষ্যে শিগগিরই ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেয়ার কথা জানালেন গোমস্তাপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আসমা খাতুন। তিনি বলেন, ‘রোববার আমি বিষয়টি জানতে পেরে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছি। আশা করি কৃষকদের সমস্যা কেটে যাবে।’